রোজা সংক্রান্ত জরুরি ১০টি প্রশ্নের উত্তর
রোজা সংক্রান্ত জরুরি ১০টি প্রশ্নের উত্তর
◈ ১) প্রশ্ন: স্ত্রীকে যৌন উত্তেজনার সাথে স্পর্শ বা আলিঙ্গন করার সময় যদি লজ্জা স্থান থেকে পানি জাতীয় পদার্থ বের হয় তাহলে কি নামাজ-রোজা হবে?
উত্তর:
স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে যৌন উত্তেজনার সাথে স্পর্শ বা আলিঙ্গন করার সময় যদি লজ্জা স্থান থেকে মনি/বীর্য (যৌন উত্তেজনা বশত: সুখানুভূতি সহকারে সবেগে স্খলিত ধাতু) নির্গত হয় তাহলে গোসল ফরজ হবে।
আর গোসল ফরজ হলে গোসল করা ছাড়া সালাত পড়া বৈধ নয়। পড়লেও কবুল হবে না।
রোজা অবস্থায় এমন হলে (বীর্যপাত হলে) রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর নিকট তওবা করত: পরবর্তীতে উক্ত রোজাটি কাজা করাই যথেষ্ট।
কিন্তু যৌন চিন্তা বা যৌন উত্তেজনা বশত: মযি/কামরস (হালকা আঠালো ও পিচ্ছিল পানি জাতীয় ধাতু) নির্গত হলে তাতে গোসল ফরজ হবে না এবং এতে রোজাও ভঙ্গ হবে না। তবে ওজু অবস্থায় নির্গত হলে ওজু ভঙ্গ হয়ে যাবে।
এটি নাপাক। সুতরাং ওযুর পূর্বে লজ্জা স্থান ধৌত করা আবশ্যক। আর কাপড়ে লাগলে এক অঞ্জলী পানি নিয়ে কাপড়ের যেখানে তা লেগেছে তার উপর ছিটিয়ে দিলেই পবিত্র হয়ে যাবে। অর্থাৎ মযি নাপক হলেও হালকা নাপাক। কাপড়ে লাগলে তা ধৌত করা আবশ্যক নয় বরং উক্ত স্থানে এক অঞ্জলী পানির ছিটা দিলে তা পবিত্র হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য যে, রোজা অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করলে-বীর্যপাত হোক না হোক-তাতে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। রমাযানের দিনের বেলা স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হওয়া কবিরা গুনাহ। কেউ এমনটি করলে তার জন্য আল্লাহর নিকট লজ্জিত অন্তরে তওবা করার পাশাপাশি কাফফারা দেয়া ওয়াজিব। তা হল:
● একটি রোজার বিনিময়ে একটি দাস মুক্ত করা।
● তা সম্ভব না হলে একটানা (বিরতি হীনভাবে) ৬০টি রোজা রাখা।
● তাও সম্ভব না হলে ৬০জন মিসকিনকে একবেলা খাবার খাওয়ানো বা প্রতিটি রোজার বিনিময়ে অর্ধ সা তথা সোয়া বা দেড় কিলোগ্রাম চাল দেয়া। (টাকা দেয়া ঠিক নয়)।
(সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
◈ ২) প্রশ্ন: গতকাল হায়েজ বন্ধ হয়েছে কিন্তু এখনো গোসল করা হয় নি। এমন অবস্থায় আজ কি রোজা রাখা যাবে?
উত্তর:
হায়েজ বা ঋতুস্রাব বন্ধ হলে গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করে ওই ওয়াক্তের সালাত পড়া ফরজ। এমনকি এক রাকআত সালাতের সময় থাকলেও তা পড়তে হবে এবং সে দিন ভোর রাত থেকে রোজা রাখাও ফরজ।
সুতরাং কোন মহিলা যদি হায়েজ বন্ধ হওয়ার পর পরের দিন পর্যন্ত গোসল না করে থাকে এবং নামায না পড়ে থাকে তাহলে সে কবিরা গুনাহগার হবে। এ ক্ষেত্রে তার জন্য আবশ্যক হল:
● আল্লাহর নিকট তওবা করা এবং গোসল করে সালাতের সময় হলে সালাত শুরু করা।
● ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়ার পর থেকে যে কয় ওয়াক্তের সালাত পড়া হয় নি সেগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে কাজা করা।
● ভোর রাতে সেহরি খেয়ে আজকের রোজা রাখা।
◈ ৩) প্রশ্ন: বমি করলে কি রোজা ভঙ্গ হবে?
উত্তর: কোন লোক যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে বমি করে তবে তার রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। কিন্তু অনিচ্ছাকৃত ভাবে বমি হলে রোজা ভঙ্গ হবেনা। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,
مَنْ ذَرَعَهُ الْقَيْءُ فَلَيْسَ عَلَيْهِ قَضَاءٌ وَمَنِ اسْتَقَاءَ عَمْدًا فَلْيَقْضِ
“অনিচ্ছাকৃত যার বমি হবে তার কোন কাজা নেই আর যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত বমি করবে সে যেন রোজা কাজা করে। ” (সহিহ আবু দাউদ, হা/২৩৮০)
কিন্তু যদি অপারগ অবস্থায় বমি বের হয়েই যায় তবে রোজা ভঙ্গ হবে না। মানুষ যদি পেটের মধ্যে খিচুনি অনুভব করে- মনে হয় যেন ভিতর থেকে সব কিছু বের হয়ে আসবে, তখন তাতে বাধা দিবে না। সাধারণভাবে থাকার চেষ্টা করবে। ইচ্ছা করে কোন কিছু বের করার চেষ্টা করবে না। নিজে নিজে বের হয়ে আসলে কোন ক্ষতি হবেনা এবং রোজাও নষ্ট হবে না।
(ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম-উসাইমীন রহ.)
◈ ৪) প্রশ্ন: রোজা অবস্থায় শ্বাসকষ্টের কারণে স্প্রে (Nabulijer) ব্যবহার করার বিধান কি? এ দ্বারা কি রোজা ভঙ্গ হবে?
উত্তর: এই স্প্রে নাকে প্রবেশ করে কিন্তু পেট পর্যন্ত পৌঁছে না। তাই রোজা রেখে ইহা ব্যবহার করতে কোন অসুবিধা নেই। এতে রোজা ভঙ্গও হবে না। কেননা এটা এমন বস্তু যা উড়ে নাকে প্রবেশ করে এবং বিলীন হয়ে যায়। এর অংশ বিশেষ পাকস্থালীতে মধ্যে প্রবেশ করে না। তাই এ দ্বারা রোজা ভঙ্গ হবে না।
(ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম-উসাইমীন রহ. প্রশ্ন নং ৪১৪)
◈ ৫) প্রশ্ন: যেকোনো খেলাধুলা করে সিয়াম পালন করলে সিয়াম পালন হবে কি? বিশেষ করে ক্রিকেট খেলা করে?
উত্তর:
রোজা রাখার পরে রোজা ভঙ্গের কোনও কারণ না ঘটলে কোন সমস্যা নেই। খেলাধুলা করতে গিয়ে কেউ যদি পিপাসায় পানি পান করে বা ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন কিছু খায় তাহলে রোজা ভঙ্গ হবে; অন্যথায় নয়।
তবে মনে রাখতে হবে, রমাযানের প্রতিটি মূহুর্ত আমাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ মর্যাদাপূর্ণ সময়গুলোকে কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, দুআ-তসবিহ ও বিভিন্ন সৎকর্ম সম্পাদনের মাধ্যম নেকি অর্জন ও কল্যাণকর কাজে ব্যয় করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা জরুরি এবং খেলাধুলায় অতিরিক্ত সময় ব্যায়, নাটক-সিনেমা দেখা বা অন্যান্য অর্থহীন কাজে যেন সময়গুলো অতিবাহিত না হয়ে যায় সে দিকে লক্ষ্য রাখা কর্তব্য। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন।
◈ ৬) প্রশ্ন: আমি অসুস্থ। রোজা রেখে কি মেডিসিন নেয়া যাবে? আমাকে দিন-রাতে ৯ বার ওষুধ খেতে হবে। কিন্তু রোজার সময়ও কি ওষুধ খেতে পারি?
উত্তর:
লা বা’স ত্বাহুর ইনশাআল্লাহ-আল্লাহ আপনাকে সুস্থতা দান করুন। আমিন।
অত:পর কথা হল, রোজা অবস্থায় ওষুধ সেবন করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। যদি ডাক্তার পরামর্শ দেয় যে, দিনরাতে কিছুক্ষণ পরপর ওষুধ খেতে হবে, অন্যথায় রোগ বৃদ্ধি পাবে বা আরগ্য বিলম্বিত হবে তাহলে আপনার জন্য এখন রোজা রাখা আবশ্যক নয়। বরং রোজা না রেখে ডাক্তারি নির্দেশনা মেতাবেক আপনি প্রয়োজন মত ওষুধ সেবন করবেন।
তবে পরে সুস্থ হলে রমাযানের পরের ছুটে যাওয়া রোজাগুলো আপনার সুবিধা জনক সময়ে কাজা করে নিবেন। (সূরা বাকারা: ১৮৪)
◈ ৭) প্রশ্ন: রোজা অবস্থায় ব্যথার কারণে মাথায় বাম বা তৈল লাগানো যাবে কি?
উত্তর: জি, সমস্যা নেই। এতে রোজার কোন ক্ষতি হবে না ইনশাআল্লাহ।
প্রশ্ন: সিয়ামরত অবস্থায় নখ-চুল বা শরীরের অবাঞ্ছিত লোম কাটা যাবে কি?
উত্তর: নখ কাটা, মাথার চুল ছাটা বা মুণ্ডন করা, মোচ খাটো করা, বগলের পশম তোলা, নাভির নিচের অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করা ইত্যাদির সাথে রোজার কোন সম্পর্ক নাই। সুতরাং রোজা অবস্থায় এগুলো করলে রোজার উপর কোন প্রভাব পড়বে না।
◈ ৮) প্রশ্ন: রোজা রেখে হারাম ভিডিও গেইম খেললে কি রোজা কি কবুল হবে?
উত্তর: এতে রোজা ভঙ্গ না হলেও সময় অপচয় ও হারাম কাজ করার কারণে তার সওয়াব কমে যাবে।
তাই রোজা অবস্থায় হারাম ভিডিও গেইম খেলা, গান-বাদ্য শোনা, নাটক-সিনেমা ইত্যাদি দেখা, খেলাধুলায় অতিরিক্ত সময় অপচয় করা থেকে বিরত থাকা জরুরি। এমনকি ইফতার করার পর এগুলো বৈধ হয়ে যাবে না বরং সর্বাবস্থায় এগুলো হারাম।
◈ ৯) রোজা অবস্থায় কান, চোখ ও নাকে ড্রপ ব্যাবহারের বিধান কি?
উত্তর:
নাক, কান ও চোখে ড্রপ ব্যবহার করলে রোজা ভঙ্গ হবে কি না এ বিষয়ে আলেমদের মাঝে দ্বিমত রয়েছে। তবে অধিক বিশুদ্ধ মতে এতে রোজা ভঙ্গ হবে না যদি গলায় ওষুধের সাধ পেলে তা গিলে না খায়। আর গিলে খেলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। তাই সতর্কতা হিসেবে যদি সম্ভব হয় তাহলে এগুলো দিনে ব্যবহার না করে রাতে ব্যবহার করা ভালো। এটাই ইসলমি ফিকহ একাডেমী এর সিদ্ধান্ত।
جاء في قرار ” مجمع الفقه الإسلامي
” الأمور الآتية لا تعتبر من المفطرات : قطرة العين ، أو قطرة الأذن ، أو غسول الأذن ، أو قطرة الأنف ، أو بخاخ الأنف ، إذا اجتنب ابتلاع ما نفذ إلى الحلق ” انتهى
তবে নাকের ছিদ্র দিয়ে ওষুধ দেয়ার ক্ষেত্রে অধিক সতর্কতা কাম্য। কেননা নাকের ছিদ্র দিয়ে পানি পাকস্থালীতে পৌঁছার সম্ভাবনা বেশি। তাই তো হাদিসে রোজা অবস্থায় অজু বা গোসল করার সময় নাকের ভেতরে বেশি করে পানি টেনে নাক ঝাড়তে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা এতে নাসারন্ধ্রের মাধ্যমে পাকস্থলীতে পানি পৌঁছে যেতে পারে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«وَبَالِغْ فِي الِاسْتِنْشَاقِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ صَائِمًا»
“(অজু ও গোসলে) নাকে পানি টেনে ভালোভাবে নাক ঝেড়ে পরিষ্কার করো যদি রোজা অবস্থায় না থাকো।” (সহিহ আবু দাউদ-আলবানী, হা/১৪২০)
◈ ১০) প্রশ্ন: রোজা অবস্থায় যদি মুখ থেকে রক্ত বের হয় তাহলে রোজার কোনও সমস্যা হবে কি?
উত্তর: মুখ, নাক বা শরীরের কাটা বা ক্ষতস্থান থেকে রক্ত নির্গত হওয়া রোজা ভঙ্গের কারণ নয়। এতে রোজা ভঙ্গ হবে না। তবে মুখ থেকে নির্গত রক্ত যদি ইচ্ছাকৃত ভাবে গিলে ফেলা হয় তাহলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। অবশ্য অসতর্কতা বশত: থুথুর সাথে তা গিলে ফেললে রোজার কোন ক্ষতি হবে না ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহু আলাম
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানি
(মদিনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সউদি আরব