🟥তারাবীহর রাক‘আত সংখ্যা
“”””””””””””””””””””””'”””””””””””””””””
📜বইঃ ছিয়াম ও ক্বিয়াম।
(১) হযরত আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন,مَا كَانَ رَسُولُ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- يَزِيدُ فِى رَمَضَانَ وَلاَ فِى غَيْرِهِ عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً، يُصَلِّى أَرْبَعًا فَلاَ تَسْأَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّى أَرْبَعًا فَلاَ تَسْأَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّى ثَلاَثًا- ‘রামাযান বা রামাযানের বাইরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রাত্রির ছালাত এগার রাক‘আতের বেশী আদায় করেননি। তিনি প্রথমে (২+২) চার রাক‘আত পড়েন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিনি (২+২) চার রাক‘আত পড়েন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিন রাক‘আত পড়েন।[1]
(২) হযরত ওমর (রাঃ) ১১ রাক‘আত তারাবীহ জামা‘আতের সাথে আদায় করার সুন্নাত পুনরায় চালু করেন, ২০ রাক‘আত নয়। যেমন হযরত সায়েব বিন ইয়াযীদ (রাঃ) বলেন,أَمَرَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ أُبَيَّ بْنَ كَعْبٍ وَتَمِيمًا الدَّارِيَّ أَنْ يَّقُومَا لِلنَّاسِ بِإِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً- ‘খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হযরত উবাই বিন কা‘ব ও তামীম দারী (রাঃ)-কে রামাযানের রাত্রিতে ১১ রাক‘আত ছালাত জামা‘আত সহকারে আদায়ের নির্দেশ প্রদান করেন…’।[2] তবে উক্ত বর্ণনার শেষদিকে ইয়াযীদ বিন রূমান প্রমুখাৎ ওমর (রাঃ)-এর যামানায় লোকেরা ২৩ রাক‘আত তারাবীহ পড়তেন’ বলে যে বাড়তি অংশ যোগ হয়েছে, সেটি মুনক্বাতি‘ বা ছিন্নসূত্র হওয়ায় যঈফ। তিনি ওমরের যামানা পাননি। উপরন্তু এটি ছহীহ হাদীছ সমূহের বিরোধী।[3]
(৩) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- فِي رَمَضَانَ ثَمَانِ رَكَعَاتٍ وَالْوِتْرَ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রামাযান মাসে আমাদেরকে ৮ রাক‘আত তারাবীহ ও বিতর ছালাত পড়ান’।[4] উরওয়া বলেন, তিনি প্রতি দু’রাক‘আত অন্তর সালাম ফিরিয়ে আট রাক‘আত তারাবীহ শেষে কখনও এক, কখনও তিন, কখনও পাঁচ রাক‘আত বিতর এক সালামে পড়তেন। কিন্তু মাঝে বসতেন না।[5]
তিরমিযীর ভাষ্যকার খ্যাতনামা ভারতীয় হানাফী মনীষী দারুল উলূম দেউবন্দ-এর মুহতামিম (অধ্যক্ষ) আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী (১২৯২-১৩৫২ হি./১৮৭৫-১৯৩৩ খৃ.) বলেন,وَلاَ مَنَاصَ مِنْ تَسْلِيْمٍ أَنَّ تَرَاوِيْحَهُ كَانَتْ ثَمَانِيَةَ رَكْعَاتٍ- ‘একথা না মেনে উপায় নেই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর তারাবীহ ৮ রাক‘আত ছিল’।[6]
সম্ভবতঃ এদিকে ইঙ্গিত করেই হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেছেন,كَيْفَ أَنْتُمْ إِذَا لَبِسَتْكُمْ فِتْنَةٌ يَهْرَمُ فِيهَا الْكَبِيرُ وَيَرْبُو فِيهَا الصَّغِيرُ، إِذَا تُرِكَ مِنْهَا شَىْءٌ قِيلَ تُرِكَتِ السُّنَّةُ؟ قَالُوا : وَمَتَى ذَاكَ؟ قَالَ : إِذَا ذَهَبَتْ عُلَمَاؤُكُمْ وَكَثُرَتْ جُهَلاَؤُكُمْ، وَكَثُرَتْ قُرَّاؤُكُمْ وَقَلَّتْ فُقَهَاؤُكُمْ، وَكَثُرَتْ أُمَرَاؤُكُمْ وَقَلَّتْ أُمَنَاؤُكُمْ، وَالْتُمِسَتِ الدُّنْيَا بِعَمَلِ الآخِرَةِ وَتُفُقِّهَ لِغَيْرِ الدِّينِ- ‘তখন তোমাদের অবস্থা কেমন হবে যখন ফিৎনা তোমাদেরকে গ্রাস করবে? যার মধ্যে বড়রা জীর্ণ হবে এবং ছোটরা বড় হবে। আর লোকেরা সেগুলিকে সুন্নাত মনে করবে। যখন তা থেকে কিছু ছেড়ে দেওয়া হবে, তখন বলা হবে সুন্নাত তরক করা হয়েছে। লোকেরা বলল, সেটা কখন হবে? তিনি বললেন, যখন তোমাদের মধ্য থেকে আলেমগণ গত হয়ে যাবেন ও জাহিলদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ক্বারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে ও ফক্বীহদের সংখ্যা হ্রাস পাবে। নেতাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে ও আমানতদারগণের সংখ্যা কমে যাবে। আখেরাতের কাজের বিনিময়ে দুনিয়া তালাশ করা হবে এবং দ্বীন ব্যতীত অন্য উদ্দেশ্যে দ্বীনের জ্ঞান হাছিল করা হবে’।[7]
উক্ত হাদীছের বাস্তবতা আমরা এখন চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছি। কোন মসজিদে ২০ রাক‘আতের বদলে ৮ রাক‘আত তারাবীহ পড়ালে ঐ ইমামের চাকুরী চলে যায় এবং তাকে অপদস্থ করা হয়। একইভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করলে ও ৩ মিনিট দেরী না করলে, সাহারী দেরীতে খেলে, জুম‘আর দিন খুৎবার সময় এক আযান দিলে ও মিম্বরে দাঁড়িয়ে মাতৃভাষায় খুৎবা দিলে, মসজিদে ই‘তিকাফের নামে ওয়ায মাহফিল ও বিরিয়ানী উৎসবের বিরুদ্ধে কথা বললে, ছালাত শেষে বা জানাযা শেষে দলবদ্ধ মুনাজাত, আখেরী মুনাজাত, শবেবরাত-শবেমে‘রাজ, নির্দিষ্টভাবে ২৭শে শবে ক্বদর, মীলাদ-ক্বিয়াম, কুলখানী-চেহলাম, দিবস পালন, বর্ষ পালন ইত্যাদি বিদ‘আত সমূহের বিরুদ্ধে কথা বললে তাদেরকে সমাজচ্যুত করা হয়। ফলে এখন বিদ‘আত হয়ে গেছে সুন্নাত। আর সুন্নাত হয়ে গেছে বিদ‘আত। এর চাইতে অধঃপতন আর কি হ’তে পারে? ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর সতর্কবাণী আমরা শুনতে পাই কি?
(৪) জ্যেষ্ঠ তাবেঈ আব্দুর রহমান বিন হুরমুয আল-আ‘রাজ আল-মাদানী (মৃ. ১১৭ হি.) বলেন,
أَدْرَكْنَا النَّاسَ إِلاَّ وَهُمْ يَلْعَنُونَ الْكَفَرَةَ فِي رَمَضَانَ قَالَ وَكَانَ الْقَارِئُ يَقْرَأُ سُورَةَ الْبَقَرَةِ فِي ثَمَانِ رَكَعَاتٍ فَإِذَا قَامَ بِهَا فِي اثْنَتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً رَأَى النَّاسُ أَنَّهُ قَدْ خَفَّفَ- ‘আমরা আমাদের মুরববী ছাহাবী বা জ্যেষ্ঠ তাবেঈদের এমন কাউকে পাইনি, যিনি রামাযানে কাফেরদের বিরুদ্ধে লা‘নত করতেন না। এ সময় ইমাম ৮ রাক‘আতে সূরা বাক্বারাহ শেষ করতেন। আর যখন সেটি ১২ রাক‘আতে শেষ করতেন, তখন লোকেরা একটু হালকা বোধ করত’।[8]
(৫) বিখ্যাত তাবেঈ আব্দুল্লাহ বিন আবুবকর বিন মুহাম্মাদ আনছারী (৬৫-১৩৫ হি.) বলেন,كُنَّا نَنْصَرِفُ فِي رَمَضَانَ فَنَسْتَعْجِلُ الْخَدَمَ بِالطَّعَامِ مَخَافَةَ الْفَجْرِ- ‘আমরা রামাযান মাসে তারাবীহ শেষে বাড়ী ফিরতাম। তখন খাদেমরা আমাদের জন্য দ্রুত সাহারীর ব্যবস্থা করত ফজর হয়ে যাওয়ার ভয়ে’।[9] অর্থাৎ তাঁরা দীর্ঘ ক্বিয়াম ও ক্বিরাআতের সাথে তারাবীহর ছালাত আদায় করতেন। এর অর্থ এটা নয় যে, তারা ঘুম থেকে উঠে ক্বিয়াম করতেন, (যেমনটি এখন অনেকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে)। বরং তাদের অধিকাংশ ঘুমের আগেই তারাবীহর ছালাত আদায় করতেন (মিরক্বাত)।
তাহাজ্জুদের ছালাতেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অধিকাংশ সময় ১১ রাক‘আত পড়তেন। যেমন আয়েশা (রাঃ) বলেন,كَانَ رَسُولُ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- يُصَلِّى فِيمَا بَيْنَ أَنْ يَّفْرُغَ مِنْ صَلاَةِ الْعِشَاءِ- وَهِىَ الَّتِى يَدْعُو النَّاسُ الْعَتَمَةَ- إِلَى الْفَجْرِ إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً، يُسَلِّمُ بَيْنَ كُلِّ رَكْعَتَيْنِ وَيُوتِرُ بِوَاحِدَةٍ- ‘রাসূল (ছাঃ) এশার ছালাত হ’তে অবসরের পর ফজর পর্যন্ত ১১ রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন। প্রতি দু’রাক‘আত পর সালাম ফিরাতেন এবং শেষে এক রাক‘আত বিতরের মাধ্যমে বেজোড় করতেন’।[10]
(৬) আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে এক বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) রাত্রিতে ১৩ রাক‘আত ছালাত আদায় করতেন’।[11] যায়েদ বিন খালেদ আল-জুহানী (রাঃ) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা এসেছে।[12] তাহাজ্জুদের ছালাত ৫, ৭ ও ৯ রাক‘আতও প্রমাণিত আছে।[13]
উপরোক্ত হাদীছসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম সকলেই ১১ রাক‘আত তারাবীহতে অভ্যস্ত ছিলেন, কখনই ২০ রাক‘আত তারাবীহ পড়েননি। অথচ সেটিই এখন অনেকের মধ্যে সুন্নাতে পরিণত হয়েছে। অনেকে বলেন, ২০ রাক‘আত তারাবীহ হ’ল ‘হুজ্জাতে ছাহাবী’। অর্থাৎ ছাহাবীদের ইজমা। অথচ একথার কোনই ভিত্তি নেই। তাছাড়া রাসূল (ছাঃ)-এর আমল পাওয়ার পরে অন্য কারু আমল দেখার বিষয় নয়।
[1]. (১) বুখারী হা/১১৪৭; (২) মুসলিম হা/১৭২৩; (৩) তিরমিযী হা/৪৩৯; (৪) আবুদাঊদ হা/১৩৪১; (৫) নাসাঈ হা/১৬৯৭; (৬) মুওয়াত্ত্বা, পৃ. ৭৪, হা/২৬৩; (৭) আহমাদ হা/২৪৮০১; (৮) ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১১৬৬; (৯) বুলূগুল মারাম হা/৩৬৭; (১০) তুহফাতুল আহওয়াযী হা/৪৩৭; (১১) বায়হাক্বী ২/৪৯৬ পৃ., হা/৪৩৯০; (১২) ইরওয়াউল গালীল হা/৪৪৫-এর ভাষ্য, ২/১৯১-১৯২; (১৩) মির‘আতুল মাফাতীহ হা/১৩০৬-এর ভাষ্য, ৪/৩২০-২১।
[2]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৭৯; মিশকাত হা/১৩০২, সনদ ছহীহ ‘ছালাত’ অধ্যায় ‘রামাযান মাসে রাত্রি জাগরণ’ অনুচ্ছেদ, রাবী সায়েব বিন ইয়াযীদ (রাঃ)।
[3]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৮০; আলবানী, হাশিয়া মিশকাত হা/১৩০২; ঐ, ছালাতুত তারাবীহ ৬১ পৃ.; ইরওয়া হা/৪৪৬।
[4]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১০৭০ ‘সনদ হাসান’ ২/১৩৮ পৃ.; মির‘আত ৪/৩২০ পৃ.।
[5]. মুসলিম হা/৭৩৬-৩৮, রাবী ‘উরওয়া বিন যুবায়ের (রাঃ)।
[6]. আল-‘আরফুশ শাযী শরহ তিরমিযী হা/৮০৬-এর আলোচনা, দ্র. ২/২০৮ পৃ.; মির‘আত ৪/৩২১ পৃ.।
[7]. দারেমী হা/১৮৫-৮৬, সনদ ছহীহ; হাকেম হা/৮৫৭০, ৪/৫৬০ পৃ. প্রভৃতি; আলবানী, ক্বিয়ামু রামাযান (বৈরূত: দার ইবনু হাযম, ৭ম সংস্করণ ১৪১৭ হি./১৯৯৭ খৃ.)।
[8]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৮১; মিশকাত হা/১৩০৩, সনদ ছহীহ।
[9]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৮২; মিশকাত হা/১৩০৪, সনদ ছহীহ।
[10]. মুসলিম হা/৭৩৬; বুখারী হা/১১২৩; মিশকাত হা/১১৮৮।
[11]. বুখারী হা/৯৯২; মুসলিম হা/৭৬৩; মিশকাত হা/১১৯৫।
[12]. মুসলিম হা/৭৬৫; মিশকাত হা/১১৯৭ ‘রাত্রির ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১।
[13]. বুখারী হা/১১৩৯; মিশকাত হা/১১৯২ ‘রাত্রির ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩১; আবুদাঊদ হা/১৪২২ প্রভৃতি; মিশকাত হা/১২৬৫ ‘বিতর ছালাত’ অনুচ্ছেদ-৩৫, রাবী আবু আইয়ূব আনছারী (রাঃ)।
Leave a Reply