ফেসবুক আসক্তি: আলামত, শরয়ী দৃষ্টি ভঙ্গী, ক্ষয়-ক্ষতি ও পরিত্রাণের উপায়
▬▬▬◍❂◍▬▬▬
প্রশ্ন: খাদ্যের পিক আপলোড করলে কি গুনাহ হবে? ফেসবুক আসক্তি সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করলে খুশি হব।
উত্তর:
জীবজন্তু, মানুষ ইত্যাদি প্রাণীর ছবি ছাড়া অন্য যে কোন বস্তুর ছবিতে কোনও গুনাহ নেই। সুতরাং খাবারের ছবি ফেসুবকে আপলোড দিলে তাতে কোনও গুনাহ নেই। তবে অন্য দৃষ্টিতে মানুষ এ বিষয়ে আপত্তি করে। তা হল, হরেক রকমের দামী দামী খাবার (বিয়ে-শাদি, ওয়ালিমা, আকিকা, মেহমানদারী ইত্যাদি) আকর্ষণীয়ভাবে সাজিয়ে ফেসবুকে আপলোড দিলে হয়ত গরিব মানুষ- যাদের এত খাবার খাওয়ার মত সমার্থ নেই- তারা মনে কষ্ট পেতে পারে।
তাছাড়া বিনা প্রয়োজনে যখন যা ইচ্ছা ফেসবুকে এসে ঢালা উচিৎ নয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় বাড়ির একান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়াদি, খাবার-দাবার, সাজ-সজ্জা, রান্নাঘর, শোয়ার ঘর, বিছানা, গরু, ছাগল, বিড়াল, কুকুর এসব অযথা ছবি পোস্ট করা ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ ও জ্ঞানীদের জন্য অশোভনীয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مِنْ حُسْنِ إسْلامِ المَرْءِ تَرْكُهُ مَا لا يَعْنِيهِ» حديث حسن رواه الترمذي وغيرُه
“মানুষের ইসলামের সৌন্দর্য হল, অনর্থক (কথা ও কাজ) বর্জন করা।” [তিরমিযি ২৩১৭, ইবনে মাজাহ ৩৯৭৬-সহিহ]
যারা বিনা প্রয়োজনে বা কেবল ‘টাইম পাস’ করার জন্য ফেসবুক জগতে উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ায়, মনে যখন যা চায় তাই স্ট্যাটাস দেয় এবং যৌবনের মূল্যবান সময়গুলোকে এভাবে হেলায়-খেলায় নষ্ট করে তারা আখিরাতে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। যেমন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,
আবু বারযাহ নাদ্বলাহ ইবনে উবাইদ আসলামি রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
لاَ تَزُولُ قَدَمَا عَبْدٍ يَومَ القِيَامَةِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ عُمُرِهِ فِيمَ أفنَاهُ ؟ وَعَنْ عِلمِهِ فِيمَ فَعَلَ فِيهِ ؟ وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أيْنَ اكْتَسَبَهُ ؟ وَفيمَ أنْفَقَهُ ؟ وَعَنْ جِسمِهِ فِيمَ أبلاهُ
‘‘কিয়ামতের দিন বান্দার পদযুগল সরবে না। (অর্থাৎ আল্লাহর নিকট থেকে যাওয়ার তাকে অনুমতি দেওয়া হবে না।) যতক্ষণ না তাকে প্রশ্ন করা হবে;
– তার আয়ু সম্পর্কে, সে তা কিসে ক্ষয় করেছে?
– তার ইলম (বিদ্যা) সম্পর্কে, সে তাতে কী আমল করেছে?
– তার সম্পদ সম্পর্কে-কী উপায়ে তা উপার্জন করেছে এবং তা কোন পথে ব্যয় করেছে?
– আর তার দেহ সম্পর্কে, কোন কাজে সে তা ক্ষয় করেছে?’’ (তিরমিযি, হাসান সূত্রে)
আল্লাহ ক্ষমা করুন। আমিন।
◈◈ ফেসবুক আসক্তি মানসিক রোগ এবং ‘ডিজিটাল কোকেন’:
প্রকৃতপক্ষে ফেসবুকে যারা বিনা দরকারে পার্সোনাল লাইভের বিভিন্ন সেলফি, পরিবারের ছবি, ঘরবাড়ি, বেডরুম, গরু-ছাগল, বিড়াল, কুকুর, খাবারদাবার, কাজকর্ম, পোশাক ইত্যাদি ছবি না দিলে বা একটু পরপর স্ট্যাটাস না দিলে মানসিক ভাবে শান্তি পায় না তারা আসলে ‘ফেসবুক আসক্ত’ এবং ‘মানসিক ভাবে অসুস্থ।’ এর পেছনে আত্মপ্রচার, কিছু লাইক ও কমেন্ট পাওয়ার অসুস্থ নেশা কাজ করে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এর চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ ফেইসবুক আসক্তিকে ‘নেশা’ আখ্যায়িত করে
বলেন, “এটি ‘ডিজিটাল কোকেন’ অ্যাডিকশনের মতো হয়ে গেছে। আজকাল ইয়ংগার জেনারেশন একবার ফেইসবুকের মধ্যে ঢুকলে আর বের হতে চায় না।” [bdnews24]
বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতও আমাদের বাংলাদেশের ‘বঙ্গবন্ধু মেডিকেল’ এ ফেসবুক আসক্তির চিকিৎসা ইউনিট খোলা হয়েছে!
‘আমাদের সময়’ পত্রিকা লিখেছে, ফেসবুকে বেশি পোস্ট দেয়া একটি ‘মানসিক রোগ’। তারপর সেখানে ফেসবুক আসক্তির আলামত এবং তার বিভিন্ন ক্ষয়-ক্ষতি তুলে ধরেছে। যেমন:
◍ ফেসবুক আসক্তির লক্ষণ:
১. নিজের সম্পর্কে অতিরিক্ত শেয়ার।
২. যখন-তখন কারণ ছাড়াই ফেসবুকে ঢোকা।
৩. প্রোফাইলের ছবিটি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া।
৪. ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিউজ ফিড পড়া এবং এগুলো নিয়ে সময় পার করা।
৫. অনলাইনের জন্য বাস্তবের জীবনকে জলাঞ্জলি দেওয়া।
৬. কাউকে বন্ধু করতে পাগলের মতো আচরণ করা।
৭. ফোনের নোটিফিকেশন বা কোনও নোটিফিকেশনের চিহ্ন দেখলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠা।
৮. কোথাও গেলে সঙ্গে সঙ্গে চেক ইন করার মাধ্যমে নিজের অবস্থান জানিয়ে দেওয়া।
৯. প্রায়ই মানুষকে ট্যাগ করা।
১০. কাজের সময় লুকিয়ে গোপনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুক ব্যবহার করা।
১১. কেউ যখন কোনও ফেসবুক পোস্টে কোনও মন্তব্য করে না তখন হতাশ হয়ে পড়া।
১২. বন্ধু সংখ্যা বাড়ানোর জন্য অপরিচিতদের তালিকায় যুক্ত করার প্রবণতা।
১৩. একেবারে মাঝ রাতে ঘুম থেকে ধড়ফড় করে উঠে ফেসবুক চেক করা।
১৪. ফেসবুক ছাড়া জীবন অচল হয়ে পড়ছে এ রকম ভাবনা পেয়ে বসা।।
◍ ফেসবুক আসক্তির ফলে যা ঘটে:
১. আবেগ-অনুভূতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
২. হতাশা ও দুশ্চিন্তা পেয়ে বসে।
৩. একাকী বোধ হয় ও নিজেকে দোষী ভাবতে শুরু করে আসক্ত ব্যক্তি।
৪. কাজের সময় ঠিকঠাক থাকে না, কাজের আগ্রহ হারিয়ে যায়।
৫. সময় জ্ঞান লোপ পায়, অসৎ পথে পরিচালিত হতে বাধ্য করে।
৬. নিজেকে অন্যর সঙ্গে তুলনা করে ঈর্ষা বোধ হতে শুরু করে।
৭. দায়-দায়িত্ব ভুলে মনোযোগ ডুবে থাকে ফেসবুকে।
৮. সম্পর্ক নষ্ট হয়, ঘর ভেঙে যেতে পারে।
[এ ছাড়াও রয়েছে, সালাত ও অন্যান্য ইবাদতে অবহেলা, দুআ ও জিকিরগুলো প্রতি অমনোযগিতা, কুরআন তিলাওয়াত, তরজমা-তাফসির জানা ও মুখস্থের প্রতি অনাগ্রহ, আলেমদের দরসে অনুপস্থিতি, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্কের ঘাটতি ইত্যাদি।]
◍ শারীরিক সমস্যা:
১. পিঠ ব্যথা ২. মাথাব্যথা ৩. স্পন্ডাইলিটিজ বা মেরুদণ্ডে সমস্যা ৪. ওজনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে কারও ওজন বেড়ে যায় আবার কারও ওজন কমে যায় ৫. ইনসমনিয়া বা ঘুমের ব্যাঘাত ৬. চোখে দেখতে সমস্যা। [somoynews.tv]
◈◈ কিভাবে বের হয়ে আসবো আসক্তি থেকে?
যখনই এই বিষয়টি আপনার দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করবে তখনই বুঝতে হবে আপনার ফেসবুক আসক্তি হয়েছে এবং এর থেকে বের হতে চেষ্টা করতে হবে।
✓ ১. টাইম লিমিট রাখা:
কখন এবং কতক্ষন ফেসবুক ব্যবহার করবেন সেটা চিন্তা করতে পারেন। একেবারে কমানোর চাইতে আস্তে আস্তে কমাতে পারেন। শুধু ওই নির্দিষ্ট সময়েই ফেসবুক ব্যবহার করবেন। এতে এই বিষয়টি একটা রুটিনের মত হয়ে যাবে।
✓ ২. নোটিফিকেশন বন্ধ রাখা:
যেসব নোটিফিকেশন অকারণেই আসে সেগুলো বন্ধ করা যেতে পারে। এতে মনোযোগ নষ্ট হবে না ।
✓ ৩. বাস্তবে বন্ধুবান্ধব তৈরী করা:
ভার্চুয়াল জীবনের বন্ধুবান্ধব তৈরীর চাইতে বাস্তবিক জীবনের বন্ধুবান্ধবদের অগ্রাধিকার দেয়া। (অবশ্যই দীনদার ও চরিত্রবান বন্ধু গ্রহন করতে হবে এবং অসৎ, দীনহীন ও খারাপ চরিত্রের বন্ধুদেরকে এড়িয়ে চলতে হবে)
✓ ৪. নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখা:
ফেসবুকে অযথা সময় নষ্ট করার চেয়ে কোনো প্রোডাক্টিভ কাজ করা যেতে পারে। এতে কাজের অভিজ্ঞতা বাড়বে যা চাকরি জীবনে পরবর্তীতে সহায়ক হবে।
✓ ৫. নিজেকে উৎসাহিত করা
যখন আপনি নিজেকে ফেসবুক ব্যবহার থেকে দূরে রাখতে পারবেন তখন নিজেকে উৎসাহিত করতে পারেন নানা ভাবে। যেমন- নিজেকে কোনো গিফট দেয়া, পছন্দের কোন খাবার খাওয়া ইত্যাদি। সব কিছুরই ভালো-মন্দ দিক রয়েছে। তবে আমরা যদি নিয়ন্ত্রিত পরিসরে ফেসবুক ব্যবহার করি সেক্ষেত্রে এর ক্ষতিকর প্রভাব অনেকটাই এড়িয়ে চলা সম্ভব।
[উৎস: blog.maya]
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ফেসবুকের মত সোশ্যাল মিডিয়াকে কল্যাণকর কাজের প্রচার-প্রসার, ইসলামে সুমহান বাণীকে ছড়িয়ে দেয়া, জ্ঞানার্জন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি উপকারী কাজে ব্যবহারের তাওফিক দান করুন এবং অনর্থক, সময় অপচয়, পাপাচার এবং ক্ষতিকর কাজে ব্যবহার থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
▬▬▬◍❂◍▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব