ফিতরা বিষয়ক জরুরি দশ
▬▬▬▬◐◯◑▬▬▬▬
নিম্নে ফিতরা সংক্রান্ত ১০টি জরুরি মাসায়েল তুলে ধরা হল:
◉ ১. জনকল্যাণ সংস্থায় ফিতরা দেয়া:
প্রশ্ন: আমাদের একটি জনকল্যাণমূলক সংস্থা আছে। আমরা সেখান থেকে ঈদের আগে কিছু গরীবদেরকে ত্রাণ দেয়ার নিয়ত করেছি। প্রশ্ন হল, আমি চাচ্ছি, আমার পরিবারের ফেতরার টাকা/খাদ্য ঐ সংস্থায় দিয়ে একসাথে গরীবদেরকে দিতে। এটা বৈধ হবে কিনা?
উত্তর:
ফিতরা পাওয়ার সর্ব প্রথম হকদার হল, গরিব-অসহায় মানুষ। সুতরাং কোনও জনকল্যাণ সংস্থার মাধ্যমে যদি তা যথাসময়ে শরিয়ত সম্মত পন্থায় হকদারদের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়া হয় তাহলে তাতে কোন আপত্তি নাই ইনশাআল্লাহ।
◉ ২. জনপ্রতি ফিতরার পরিমাণ:
প্রশ্ন: আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৭ জন। প্রতি জনের কি ৩ কেজি করে দিতে হবে? তার মানে ৩×৭=২১ কেজি?
উত্তর:
হাদিসে ফিতরার পরিমাণ বলা হয়েছে, এক ‘সা পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য। তৎকালীন সা বর্তমান যুগের কেজির হিসেবে কী পরিমাণ সে ব্যাপারে বিজ্ঞ আলেমদের মধ্যে কিছুটা দ্বিমত দেখা যায়। (অবশ্য এ ক্ষেত্রে সা নামক পাত্র দ্বারা যে ধরণের খাদ্যদ্রব্য পরিমাপ করা হয় সে জিনিসটার ভিত্তিতে ওজনে কম-বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। যেমন: একটা পাত্রে খেজুর আর গম/চাল মাপা হলে অবশ্যই উভয়টির ওজনে কমবেশি হবে।)
যাহাকে এ ক্ষেত্রে অধিক সতর্কতার জন্য সর্বোচ্চ বেশি দেয়ার অভিমতটা গ্রহণ করা অধিক উত্তম। সে হিসেবে আপনি জনপ্রতি ৩ কেজি চাল ফিতরা দিতে পারেন। তাহলেই যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ। অত:এব আপনার পরিবারের ৭ জনের ফিতরা ২১ কেজি চাল দিবেন। আল্লাহ কবুল করুন। আমিন।
◉ ৩. এক বা একাধিক গরিবের মাঝে ফিতরা বণ্টন:
প্রশ্ন: আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৬ জন। এখন আমি কি ৬ জন গরিব লোককে আমার পরিবারের ফিতরা ভাগ করে দেব নাকি কাওকে কম-বেশি দেয়ার কোন সুযোগ আছে?
উত্তর:
একাধিক ব্যক্তির ফিতরা যেমন একজন গরিবকে দেয়া জায়েজ আছে তেমনি একজনের ফিতরা একাধিক গরিবকে দেয়াও জায়েজ আছে। পরিস্থিতি ও মানুষের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ রেখে বিতরণ করবেন। মোটকথা, ফিতরা গবিরদের হাতে তা গেলেই যথেষ্ট।
বিস্তারিত পড়ুন: একজনের ফিতরা একাধিক গরিবের মাঝে বণ্টন করা
https://m.facebook.com/Guidance2TheRightPath/posts/709473546138860
◉ ৪. এমন গরিবকে যাকাত-ফিতরা দেয়া যে হারাম কাজে অর্থ খরচ করবে বলে আশঙ্কা আছে:
প্রশ্ন: একজন গরিব বিধবা মহিলা কিন্ত সে সুদে টাকা খাটায়। তাকে কি সাধারণ দান, ফিতরা, যাকাত ইত্যাদি দেয়া যাবে?
উত্তর:
এমন ব্যক্তিকে যাকাত-ফিতরা দেয়া উচিৎ নয়, যার ব্যাপারে আশংকা থাকে যে, সে অর্থ হাতে পেলে প্রাপ্ত অর্থ সুদি কারবারে খাটাবে অথবা তা বিড়ি-সিগারেট ক্রয়, মদপান বা বিভিন্ন হারাম কাজ ব্যয় করবে।
সুতরাং যে ব্যক্তি সুদে টাকা খাটায় তাকে জেনেবুঝে যাকাত-ফিতরা দেয়া বৈধ নয়। কারণ সে আপনার দেয়া অর্থকে হারাম কাজে ব্যবহার করলে হারাম কাজে সহায়তার কারণে আপনিও গুনাহের অংশিদার হবেন। অথচ আল্লাহ তা নিষেধ করেছেন। যেমন:আল্লাহ তা’আলা বলেন,
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَاب
“সৎকর্ম ও আল্লাহ ভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না।” (সূরা মায়িদাহ: ২)
বরং এমন দ্বীনদার-পরহেজগার গরিব-অসহায় মানুষ যাকাত-ফিতরা পাওয়ার বেশি হকদার যে ব্যক্তি প্রাপ্ত অর্থকে নিজে দরকারী বৈধ কাজে ব্যবহার করবে বা দীনের কাজে লাগাবে।
সুতরাং যথাসম্ভ এ জাতীয় গরিব-অসহায় ভালো মানুষগুলোকে খুঁজে বের করে তাদেরকে যাকাত-ফিতরা প্রদান এবং বিভিন্নভাবে আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতা করার চেষ্টা করা উচিৎ।
الله الموفق
◉ ৫. দেশ থেকে প্রবাসী আত্মীয়ের ফিতরা আদায় করা:
প্রশ্ন: আমার বড় ভাই দেশের বাহিরে থাকে। তার ফিতরা কিভাবে আদায় করব?
উত্তর:
এ লেখাটা পড়ার অনুরোধ করছি: প্রবাসীরা কি তাদের ফিতরা দেশে দিতে পারে? দিলে কিভাবে দিবে?
m.facebook.com/Guidance2TheRightPath/posts/697817343971147
◉ ৬. লক ডাউনে গরিবদের নিকট চাল পাঠানো সম্ভব না হলে ফিতরার মূল্য বিকাশ করা:
প্রশ্ন: এলাকা লক ডাউনের কারণে কোন গরীব অসহায় মানুষকে দেখতে পাচ্ছি না বা কেউ বাসায় আসতে পারছে না। সেক্ষেত্রে কি এ ২১ কেজি চালের টাকা বা ২১ কেজি চাল কি মসজিদে দিয়ে দিলে ফিতরা আদায় হয়ে যাবে? আর যদি না হয় সেজন্য কিভাবে ফিতরা আদায় করব?
উত্তর:
ফিতরা পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার হল, গরিব-অসহায় মানুষ। সুতরাং সম্ভব হলে গরিবের বাড়িতে গিয়ে চালের বস্তা দিয়ে আসবেন অথবা ফোন করে বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে বলবেন।
কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে লক ডাউনের কারণে চেষ্টা করার পরও যদি ঈদের আগে গরিব-অসহায় মানুষের নিকট ফিতরার চাল পৌঁছানো সম্ভব না হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে ফিতরার চাল আপনার সম্পদ থেকে আলাদা করে রাখবেন। পরে যখন সুযোগ পাবেন তখন তাদেরকে দিবেন।
তবে বিলম্ব করার কারণে যদি গরিব-অসহায় মানুষের অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে তাদের অবস্থা বিবেচনায় ফিতরার চালের মূল্যটা তাদের নিকট বিকাশও করে দিতে পারেন। কারণ এটা হল, নিরুপায় অবস্থা।
এ ক্ষেত্রে আপনারা বছরের অধিকাংশ সময় যে মানের চালের ভাত খান সে মানের ৩ কেজি চালের মূল্য বিকাশ করবেন। (জনপ্রতি)
আল্লাহু আলাম
◉ ৭. করোনায় সরকার থেকে প্রাপ্ত রেশন দ্বারা ফিতরা আদায়:
প্রশ্ন: করোনা পরিস্থিতিতে দেশের রেশন ব্যবস্থায় বিনামূল্যে চাল, গম, আটা ইত্যাদি পাওয়া গেলে এসব খাদ্যসামগ্রী দিয়ে কি ফিতরা দেওয়া বৈধ হবে কি?
উত্তর:
সুন্নাহ সম্মত নিয়ম হল, প্রত্যেক ব্যক্তি অধিকাংশ সময় যে ধরণের চাল খায় সে ধরণের চাল দ্বারা ফিতরা দিবে। তবে বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে কেউ যদি সরকারীভাবে রেশন হিসেবে চাল পায় আর তার মান যদি সে যেমন চাল খায় তার অনুরূপ হয় তাহলে তা দিয়ে ফিতরা দিতে কোন আপত্তি নাই। কিন্তু তা খুব নিম্নমানের হলে দেয়া যাবে না। অবশ্য এ ক্ষেত্রে অন্য বিকল্প না থাকলে রেশনের চাল যেমনই হোক না কেন তা দ্বারা ফেতরা দিলে আদায় হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহু আলাম।
◉ ৮. গোসত, মাছ, তেল, সেমাই ইত্যাদি দ্বারা ফিতরা আদায়:
প্রশ্ন: ফিতরা খাদ্রদ্রব্য দ্বারা দিব কিন্তু ঈদের দিন অনেক পরিবার পোলাও-গোস্ত রান্না করে। তাই পোলাও এর চাল, গোস্ত, মাছ, তেল এগুলা কি ফিতরা হিসেবে দেয়া যাবে? দেয়া গেলে এগুলো কী পরিমাণে দিতে হবে?
উত্তর:
অধিক বিশুদ্ধ মতে, দেশের প্রচলিত প্রধান খাদ্যদ্রব্য (যেমন: আমাদের দেশে চাল)। তাই চাল দ্বারা ফিতরা আদায় করা সুন্নত। এ ছাড়া অন্য কিছু-যেমন: মাছ, মাংস, সবজি, ডাল, চিনি, মসলা, সেমাই, গুড়াদুধ, টাকা, জামা-কাপড় ইত্যাদি-দ্বারা ফিতরা দেয়া সুন্নত সম্মত নয়। অনেক আলেমের মতে, এগুলো দ্বারা ফিতরা আদায় হবে না। (যদিও আমাদের দেশে টাকা দিয়ে ফেতরা দেয়ার ফতোয়া প্রচলিত রয়েছে।)
চাল দ্বারা ফিতরা আদায়ের পর উপরোক্ত বস্তুগুলো দান হিসেবে দেয়া যেতে পারে।
পাশাপাশি সম্ভব হলে তাদেরকে আলাদাভাবে কিছু অর্থ দান করবেন সাধারণ সদকা হিসেব; ফিতরা হিসেবে নয়। অথবা টাকা দিয়ে সম্পদের জাকাত দিবেন। যেন তারা টাকা দ্বারা খাদ্য ছাড়া তাদের অন্যান্য প্রয়োজন পূরণ করতে পারে।
◈ বিস্তারিত পড়ুন: যাকাতুল ফিতর (ফিতরা) হিসেবে টাকা দেয়া সুন্নত না কি খাদ্যদ্রব্য?
https://m.facebook.com/Guidance2TheRightPath/posts/476037349482482
◉ ৯. অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের ফিতরা:
প্রশ্ন: অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তান-যাদের উপর সিয়াম পালন ফরজ হয় নি-তাদের পক্ষ থেকে কি ফিতরা প্রদান করতে হবে?
উত্তর:
হ্যাঁ, পরিবারে ছোট-বড় সকলের পক্ষ থেকে ফিতরা দিতে হবে। এমনকি ঈদের চাঁদ উদিত হওয়ার পূর্বে কোনও সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তারও ফিতরা দেয়া আবশ্যক। কিন্তু ঈদের পরে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার ফেতরা দেয়া মুস্তাহাব; ওয়াজিব নয়।
◉ ১০. গরিবদের ফিতরা:
প্রশ্ন: যে সকল গরিবরা ফিতরা গ্রহণ করে তাদের জন্যও কি ফিতরা দেওয়া ফরজ?
উত্তর:
ঈদের দিনের নিজ পরিবারে খাওয়ার মত অর্থ-সম্পদ এবং ফিতরা দেয়ার সামর্থ্য থাকলে ফিতরা প্রদান করা আবশ্যক। সুতরাং ফিতরা গ্রহণকারীও নিজের গুনাহ মোচনের স্বার্থে ফিতরা দিবে। এমনকি সে অন্যদের থেকে প্রাপ্ত ফিতরা থেকেও নিজেদের ফিতরা দিতে পারে।
আল্লাহু আলাম।
ফিতরা বিষয়ক আরো অন্যান্য লেখা পড়ুন এখানে:
https://m.facebook.com/…/a.25187732…/955868218166057/…
▬▬▬▬◐◯◑▬▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব
Leave a Reply