সূরা আন-নাস
-আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ
(সূরা আন-নাস: মক্কায় অবতীর্ণ, আয়াত- ০৬, অক্ষর- ৯০)
بسم الله الرحمن الرحيم
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ (1) مَلِكِ النَّاسِ (2) إِلَهِ النَّاسِ (3) مِنْ شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ (4) الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ (5) مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ (6)
অনুবাদ : দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে শুরু করছি।
(১) হে নবী! আপনি বলুন, আমি আশ্রয় চাচ্ছি মানুষের প্রতিপালক (২) মানুষের অধিপতি (৩) মানুষের (প্রকৃত) মা‘বূদের নিকট (৪) আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট হতে (৫) যে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয় (৬) সে জিনের মধ্যে থেকে হোক বা মানুষের মধ্যে থেকে।
শব্দার্থ :
قُلْ – (হে নবী!) আপনি বলুন।
أَعُوذُ – আমি আশ্রয় চাই।
رَبِّ- প্রতিপালক।
النَّاسِ- মানুষ, লোক।
مَلِكِ- অধিপতি।
إِلَهِ – মা‘বূদ, যার ইবাদত করা হয়।
شَرِّ – অনিষ্ট, ক্ষতি, অকল্যাণ।
الْوَسْوَاسِ- কুমন্ত্রণাদাতা। শব্দটি বিশেষ্য। অর্থ : শয়তান, যে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয়। মানুষের অন্তরে যে খারাপ পরিকল্পনা জাগে তাকেও الْوَسْوَاسِ বলে। প্রত্যেক যে জিনিসে কোন প্রকার কল্যাণ থাকে না তাকেও الْوَسْوَاسবলা হয়। মানুষের মনের কথাকেও الْوَسْوَاسِ বলে।
الْخَنَّاسِ- বেশী বেশী আত্মগোপনকারী। যে পিছন দিকে সরে যায় বা যে কাউকে পিছন দিকে সরিয়ে দেয় কিংবা সেখান থেকে সরে যায়। শয়তানকেও الْخَنَّاسِ বলে। কেননা মানুষ যখন আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন সে পিছে সরে যায়। আল্লাহর যিকির বন্ধ করলে সে আবার ফিরে আসে।
يُوَسْوِسُ- কুমন্ত্রণা দেয়, মনে সন্দেহ জাগায়।
এ মর্মে অবতীর্ণ আয়াতসমূহ :
শয়তানের পক্ষ থেকে কোন উসকানি অনুভব করলে, আল্লাহ তার থেকে আশ্রয় চাওয়ার জন্য আদেশ করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ‘আর যদি শয়তানের পক্ষ থেকে তোমরা কোন উসকানি অনুভব কর তাহলে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাও। নিশ্চয় তিনি সবকিছু শুনেন এবং সবকিছু জানেন’ (আ‘রাফ, ২০০)। এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, শয়তানের উসকানি অনুভব করার সাথে সাথে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে হবে; যাতে শয়তান কোন প্রকার ক্ষতি করতে না পারে।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَقُلْ رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ ‘(হে নবী!) আপনি বলুন, হে আমার প্রতিপালক! আমি আপনার নিকট শয়তানের উসকানি থেকে আশ্রয় চাচ্ছি’ (মুমিনূন, ৯৭)। এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নবী (ছাঃ)-কে শয়তানের উসকানি হতে আশ্রয় চাওয়ার জন্য আদেশ করেছেন।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُمْ مُبْصِرُونَ ‘নিশ্চয় যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের অবস্থা এমন হয় যে, কখনো শয়তানের প্রভাবে কোন অসৎ চিন্তা তাদেরকে স্পর্শ করলে তারা সাথে সাথে সজাগ হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার পরপরই তাদের সামনে সঠিক পথ পরিষ্কার হয়ে ভেসে উঠে’ (আ‘রাফ, ২০১)। এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, পরহেযগার মানুষ শয়তানের উসকানি অনুভব করার সাথে সাথে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আল্লাহর নিকট আশ্রয় চায়। ফলে তাৎক্ষণিক তারা সঠিক পথ দেখতে পায়।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ ‘আর আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং মানুষের অন্তর যা প্ররোচনা করে, আমি তা জানি। আমি তার গলার শিরা হতেও অধিক নিকটবর্তী (ক্বাফ, ১৬)। এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, মানুষের অন্তরে শয়তানের কুমন্ত্রণা জাগে। এ ব্যাপারে আল্লাহ অন্যত্র বলেন,إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ ‘নিশ্চয় মানুষের অন্তর পাপের আদেশ করে’ (ইউসুফ, ৫৩)। এ সময় মানুষ যদি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায়, তাহলে গলার শিরা বা রগ মানুষের যত নিকটে আছে, আল্লাহ তার চেয়েও নিকট হতে সাড়া দিবেন।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,فَوَسْوَسَ إِلَيْهِ الشَّيْطَانُ قَالَ يَا آدَمُ هَلْ أَدُلُّكَ عَلَى شَجَرَةِ الْخُلْدِ وَمُلْكٍ لَا يَبْلَى ‘শয়তান আদমকে কুমন্ত্রণা দিয়ে বলল, হে আদম! আমি কি আপনার কাছে স্থায়ী গাছের কথা বলব না এবং এমন একটি রাজত্বের কথা বলব না, যা কখনো ধ্বংস হবে না’ (ত্ব-হা, ১২০)। এ আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, শয়তান মানুষকে কুমন্ত্রণা দেয়। মিথ্যা ও পাপ কাজ করার আদেশ করে। যেমন আদম (আঃ)-কে কুমন্ত্রণা দিয়ে স্থায়ী গাছের কথা এবং স্থায়ী রাজত্বের কথা বলেছিল। এ ছিল তার প্রতারণা।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَعْشُ عَنْ ذِكْرِ الرَّحْمَنِ نُقَيِّضْ لَهُ شَيْطَانًا فَهُوَ لَهُ قَرِينٌ ‘যে ব্যক্তি রহমানের স্মরণ হতে গাফেল হয়ে জীবন যাপন করে, আমি তার উপর এক শয়তানকে চাপিয়ে দেই এবং সে তার সঙ্গী-সাথী হয়ে যায়’ (যুখরুফ, ৩৬)। এ আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, মানুষ যখন আল্লাহর যিকির-আযকার হতে গাফেল থাকে, শয়তান তখন তার সঙ্গী হয়ে যায়। শয়তান তাকে পরিচালনা করে। পাপ কাজ, চোগলখোরি, কুটনামি, মিথ্যা কথা, সর্বধরনের অন্যায়কে তার সামনে সুন্দর করে তুলে ধরে। তখন সে খুব সহজেই পাপ কাজে লিপ্ত থাকে।
وَقَالَ الشَّيْطَانُ لَمَّا قُضِيَ الْأَمْرُ إِنَّ اللَّهَ وَعَدَكُمْ وَعْدَ الْحَقِّ وَوَعَدْتُكُمْ فَأَخْلَفْتُكُمْ وَمَا كَانَ لِيَ عَلَيْكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ إِلَّا أَنْ دَعَوْتُكُمْ فَاسْتَجَبْتُمْ لِي فَلَا تَلُومُونِي وَلُومُوا أَنْفُسَكُمْ مَا أَنَا بِمُصْرِخِكُمْ وَمَا أَنْتُمْ بِمُصْرِخِيَّ إِنِّي كَفَرْتُ بِمَا أَشْرَكْتُمُونِ مِنْ قَبْلُ إِنَّ الظَّالِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
‘আর যখন চূড়ান্ত ফায়ছালা করা হবে, তখন শয়তান বলবে, এতে কোনই সন্দেহ নেই যে, তোমাদের প্রতি আল্লাহ যেসব ওয়াদা করেছেন, তার সবই সত্য ছিল। আর আমি যত ওয়াদা করেছিলাম, তার সবটারই উল্টো করেছি। তোমাদের উপর আমার কোন জোর ছিল না। আমি এছাড়া আর কিছুই করিনি, শুধু এটাই করেছি যে, তোমাদেরকে আমার পথে চলার জন্য আহবান করেছি। আর তোমরা আমার আহবানে সাড়া দিয়েছ। এখন আমার দোষ দিও না, আমাকে তিরস্কার কর না, নিজেরাই নিজেদেরকে তিরস্কার কর। এখানে আমিও তোমাদের সাহায্য করতে পারব না, দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে পারব না। তোমরাও আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। ইতোপূর্বে তোমরা যে আমাকে আল্লাহর শরীক হিসাবে গ্রহণ করেছিলে, আমি এখন তা অস্বীকার করলাম। নিশ্চয়ই এমন অত্যাচারীদের জন্য কঠিন শাস্তি রয়েছে’ (ইবরাহীম, ২২)।
সুধী পাঠক! উক্ত আয়াতে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় যে, শয়তান মানুষের দ্বারা কীভাবে পাপ কাজ করিয়ে নেওয়ার মিথ্যা কৌশল অবলম্বন করে। কীভাবে মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দেয় এবং কীভাবে বিচারের মাঠে সব অস্বীকার করবে। কাজেই সমস্ত মুসলিম জাতিকে শয়তানের কুমন্ত্রণা হতে সাবধান থাকতে হবে এবং এভাবে আশ্রয় চাইতে হবে:
দু‘আ-১ :
رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ – وَأَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَحْضُرُونِ
‘হে আমার প্রতিপালক! আমি সব শয়তানের উসকানি হতে তোমার নিকট আশ্রয় চাই। আর হে আমার প্রতিপালক! আমার কাছে তাদের উপস্থিতি হতে তোমার নিকট আশ্রয় চাই’।[1]
দু‘আ-২ :
اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ مِنْ هَمْزِهِ وَنَفْخِهِ وَنَفْثِهِ
ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! অভিশপ্ত শয়তান, তার অহমিকা, তার জাদু ও তার কুমন্ত্রণা হতে তোমার নিকট আশ্রয় চাই’।[2]
দু‘আ-৩ :
أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ
সুলায়মান ইবনু ছুরাদ (রাঃ) বলেন, দু’জন লোক নবী করীম (ছাঃ)-এর কাছে গালাগালি করতে লাগল। তাদের একজনের রাগে দু’চক্ষু লাল হয়ে যায় এবং গাল ফুলে যায়। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘আমি এমন একটি দু‘আ জানি যদি সে এ দু‘আটি বলে, তাহলে তার এ রাগ দূর হয়ে যাবে, যা সে অনুভব করছে। দু‘আটি হচ্ছে, أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ ‘আমি অভিশপ্ত শয়তান হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি’।[3]
দু‘আ-৪ :
آمَنت بِاللَّه رُسُلِهِ
‘আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি ঈমান এনেছি’।[4]
এই সূরার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, হে নবী! আপনি বলুন, আমি মানুষের প্রতিপালকের কাছে আশ্রয় চাই। অতএব, সবকিছুর প্রতিপালক শুধুমাত্র তিনিই। এ মর্মে আল্লাহ আরো বলেন, الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ ‘সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য যিনি বিশ্ব জগতের প্রতিপালক’ (ফাতিহা, ১)। এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, বিশ্বজগতের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ ‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর’ (বাক্বারাহ, ২১)। এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর সকল মানুষকে আদেশ করে বলেন, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর। তার একত্ব বর্ণনা কর।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَلْيَعْبُدُوا رَبَّ هَذَا الْبَيْتِ ‘তাদের উচিত তারা যেন এ ঘরের প্রতিপালকের ইবাদত করে’ (কুরাইশ, ৩)। এই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীর সকল মানুষকে কা‘বা ঘরের প্রতিপালকের ইবাদত করার জন্য আদেশ করেন।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,أَغَيْرَ اللَّهِ أَبْغِي رَبًّا وَهُوَ رَبُّ كُلِّ شَيْءٍ ‘হে নবী! আপনি বলুন, আমি কি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অপর কোন প্রতিপালককে তালাশ করব? অথচ তিনিই সবকিছুর একমাত্র প্রতিপালক’ (আন‘আম, ১৬৪)। এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা যারা প্রতিপালক হওয়ার দাবী রাখে, তাদের সকলকে প্রত্যাখ্যান করে একমাত্র নিজেকে সবকিছুর প্রতিপালক বলে ঘোষণা করেছেন।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ قُلِ اللَّهُ ‘হে নবী! আপনি এসব লোককে জিজ্ঞেস করুন? আসমান-যমীনের প্রতিপালক কে? অতঃপর আপনি বলুন, আসমান-যমীনের একমাত্র প্রতিপালক আল্লাহ’ (রা‘দ, ১৬)। এই আয়াতে প্রতীয়মান হয় যে, আসমান-যমীনের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,إِنَّمَا أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ رَبَّ هَذِهِ الْبَلْدَةِ ‘নিঃসন্দেহে আমাকে আদেশ করা হয়েছে যে, আমি এ শহরের প্রতিপালকের ইবাদত করব’ (নামল, ৯১)।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, رَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ ‘সম্মানিত আরশের প্রতিপালক’ (মুমিনূন, ১১৬)।
উল্লেখিত আয়াতসমূহে লক্ষ্যণীয় যে, আসমান, যমীন ও আরশ সহ সবকিছুর প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
এ মর্মে বর্ণিত ছহীহ হাদীছসমূহ :
হাদীছ নং ১:
عَنْ أََنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَجْرِىْ مِنَ الْاِنْسَانِ مَجْرَى الدَّمِ-
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘শয়তান মানুষের মাঝে তার রক্তের ন্যায় বিচরণ করে থাকে’।[5] এই হাদীছে বুঝা যায় যে, প্রবল ক্ষমতার অধিকারী শয়তান। মানুষের রক্ত তার শরীরের যেসব স্থানে চলাচল করে, সেসব স্থানে শয়তান যেতে পারে। এতে বুঝা যায় যে, শয়তান মানুষকে সহজেই ভুল পথে নিয়ে যেতে সক্ষম। কাজেই মানুষকে শয়তানের ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে।
হাদীছ নং ২:
عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَا مِنْكُمْ مِّنْ أَحَدٍ إِلاَّ وَقَدْ وُكِّلَ بِهِ قَرِيْنُهُ مِنَ الْجِنِّ وَقَرِيْنُهُ مِنَ الْمَلاَئِكَةِ قَالُوْا وَإِيَّاكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ وَإِيَّاىَ وَلَكِنَّ اللهَ أَعَانَنِىْ عَلَيْهِ فَأَسْلَمَ فَلاَ يَأْمُرُنِىْ إِلاَّ بِخَيْرٍ-
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার সাথে তার জিন জাতীয় সহচর (কারীন)-কে অথবা ফেরেশতা জাতীয় সহচরকে নিযুক্ত করে দেওয়া হয়নি’। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)! আপনার সাথেও কি? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘হ্যাঁ আমার সাথেও, তবে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছেন। অতএব সে আমার অনুগত হয়ে গেছে, সে কখনও আমাকে ভাল ব্যতীত (মন্দ কাজের) পরামর্শ দিতে পারে না’।[6] এ হাদীছে বুঝা যায়, মানুষের সাথে সর্বদা ভাল সঙ্গী অথবা খারাপ সঙ্গী থাকে। ভাল সঙ্গী হলেন ফেরেশতা, আর খারাপ সঙ্গী হল শয়তান। অতএব মানুষকে বুঝতে হবে, শয়তান সর্বদা মানুষের সাথেই রয়েছে।
হাদীছ নং ৩:
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ مَا مِنْ بَنِىْ آدَمَ مَوْلُوْدٌ إِلاَّ يَمَسُّهُ الشَّيْطَانُ حِيْنَ يُوْلَدُ فَيَسْتَهِلُّ صَارِخًا مِّنْ مَّسِّ الشَّيْطَانِ غَيْرَ مَرْيَمَ وَ اِبْنِهَا-
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন সন্তান প্রসব করা হয়, তখন যে শয়তান তাকে স্পর্শ করে না এবং সে চিৎকার দিয়ে উঠে না, এমন আদম সন্তানই জন্ম হয় না, মারইয়াম ও তাঁর পুত্র ব্যতীত’।[7] এ হাদীছে বুঝা যায়, মানুষ জন্ম নেওয়ার সাথে সাথেই শয়তান তাকে আঘাত করে, শয়তান তার উপর প্রভাব বিস্তার করে। যার কারণে বাচ্চা চিৎকার করে উঠে। তবে মারইয়াম এবং তার সন্তান ঈসা (আঃ)-কে শয়তানের আঘাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে। এটা আল্লাহর তা‘আলার তাদের উপর বিশেষ দয়া। শয়তানের স্পর্শই চিৎকারের একমাত্র কারণ একথা বুঝাবার জন্য হাদীছটির অবতারণা নয়। বরং মানব জন্মের প্রথম দিন হতেই যে শয়তান তার পিছনে লেগে যায়, একথা বুঝাবার জন্যই হাদীছটির অবতারণা। সুতরাং চিৎকারের অন্য কারণও থাকতে পারে। যথা- মাতৃগর্ভের গরম হতে হঠাৎ পৃথিবীর ঠান্ডায় আসা। একটি কাজের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। মারইয়ামের মাতা মারইয়ামও তাঁর সন্তানের জন্য দু‘আ করেছিলেন। তাই তাদেরকে শয়তান স্পর্শ করতে পারেনি।
হাদীছ নং ৪:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صِيَاحُ الْمَوْلُوْدِ حِيْنَ يَقَعُ نَزْغَةٌ مِّنْ الشَّيْطَانِ-
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘প্রসবকালে শিশুর চিৎকার শয়তানের খোঁচার দরুণই হয়ে থাকে’।[8] এ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয়, জন্মের সময় বাচ্চার কান্নার কারণ এটাই।
হাদীছ নং ৫:
عَنْ جَابِرٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ إِبْلِيْسَ يَضَعُ عَرْشَهُ عَلَى الْمَاءِ ثُمَّ يَبْعَثُ سَرَايَاهُ فَأَدْنَاهُمْ مِّنْهُ مَنْزِلَةً أَعْظَمُهُمْ فِتْنَةً يَجِيْئُ أَحَدُهُمْ فَيَقُوْلُ فَعَلْتُ كَذَا وَكَذَا فَيَقُوْلُ مَا صَنَعْتَ شَيْئًا قَالَ ثُمَّ يَجِيْئُ أَحَدُهُمْ فَيَقُوْلُ مَا تَرَكْتُهُ حَتَّى فَرَّقْتُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ امْرَأَتِهِ قَالَ فَيُدْنِيْهِ مِنْهُ وَيَقُوْلُ نِعْمَ أَنْتَ قَالَ الْأَعْمَشُ أُرَاهُ قَالَ فَيَلْتَزِمُهُ-
জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘শয়তান পানির উপর তার সিংহাসন স্থাপন করে। অতঃপর মানুষের মধ্যে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্য চারিদিকে তার সৈন্য-সামন্ত প্রেরণ করে। এদের মধ্যে তার নিকট সর্বাধিক সম্মানিত সেই, যে সর্বাধিক বড় ফেতনা সৃষ্টি করতে পারে। তাদের মধ্যে কেউ এসে বলে, (প্রভু) আমি এরূপ এরূপ (অনিষ্ট) সাধন করেছি। সে তখন বলে, তুমি কিছু করনি’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘অতঃপর অপর একজন এসে বলে, আমি মানব সন্তানকে ছাড়িনি, এমনকি তার ও তার স্ত্রীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছি’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘শয়তান তাকে নিকটে করে নেয় এবং বলে, বেশ ভাল, তুমিই উত্তম কাজ করেছো’। রাবী আ‘মাশ (রাঃ) বলেন, আমি মনে করি, জাবের (রাঃ) এটাও বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘অতঃপর শয়তান তার সাথে কোলাকুলি করে’।[9]
হাদীছ নং ৬:
عَنْ جَابِرٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ أَيِسَ مِنْ أَنْ يَّعْبُدَهُ الْمُصَلُّوْنَ فِيْ جَزِيْرَةِ الْعَرَبِ وَلَكِنْ فِيْ التَّحْرِيْشِ بَيْنَهُمْ-
জাবির (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘শয়তান একথা হতে নিরাশ হয়ে গেছে যে, আরব উপদ্বীপে মুছল্লীরা (মূর্তিপূজার মারফতে) তাকে পূজা করবে, কিন্তু সে তাদের একের বিরুদ্ধে অপরকে লেলিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে নিরাশ হয়নি’।[10] এ হাদীছে বুঝা যায়, আরব উপদ্বীপের মানুষ মূর্তিপূজা করবে না, কবর পূজা করবে না, কবরে মানত মানবে না। তবে পরস্পরে গন্ডগোল হবে, খুনাখুনি-মারামারি হবে। শয়তান এসব ব্যাপারে তাদেরকে উসকানি দিতে সক্ষম হবে।
হাদীছ নং ৭:
عَنْ عُثْمَانَ بْنِ أَبِي الْعَاصِ قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ الشَّيْطَانَ قَدْ حَالَ بَيْنِيْ وَبَيْنَ صَلَاتِيْ وَقِرَاءَتِيْ يَلْبِسُهَا عَلَيَّ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ ذَاكَ شَيْطَانٌ يُقَالُ لَهُ خِنْزَبٌ فَإِذَا أَحْسَسْتَهُ فَتَعَوَّذْ بِاللهِ مِنْهُ وَاتْفِلْ عَلَى يَسَارِكَ ثَلَاثًا قَالَ فَفَعَلْتُ ذَلِكَ فَأَذْهَبَهُ اللهُ عَنِّيْ-
ওছমান ইবনে আবিল ‘আছ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললাম, শয়তান আমার এবং আমার ছালাত ও কিরাআতের মধ্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং এতে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব লাগিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘সে একটা শয়তান, তাকে ‘খিনযাব’ বলা হয়। যখন তুমি তার উপস্থিতি অনুভব করবে, তখন তা হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইবে এবং বামদিকে তিনবার থুথু ফেলবে’। অতঃপর আমি এরূপ করলে আল্লাহ তা‘আলা আমা হতে তাকে দূর করে দেন’।[11] এ হাদীছে বুঝা যায়, ছালাতের মধ্যে যে শয়তান উসকানি দেয়, তাকে খিনযাব বলে। খিনযাবের উপস্থিতি অনুভব করলে বাম দিকে হালকা করে তিন বার থুথু নিক্ষেপ করতে হবে এবং মুখে বলতে হবে, أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ তাহলে আল্লাহ শয়তানকে সরিয়ে দিবেন।
হাদীছ নং ৮:
عَنِ الْقَاسِمِ بْنِ مُحَمَّدٍ أَنَّ رَجُلاً سَأَلَهُ فَقَالَ إِنِّيْ أَهِمُ فِيْ صَلَاتِيْ فَيَكْثُرُ ذَلِكَ عَلَيَّ فَقَالَ لَهُ الْقَاسِمُ بْنُ مُحَمَّدٍ امْضِ فِيْ صَلَاتِكَ فَإِنَّهُ لَنْ يَّذْهَبَ عَنْكَ حَتَّى تَنْصَرِفَ وَأَنْتَ تَقُوْلُ مَا أَتْمَمْتُ صَلَاتِيْ-
তাবেঈ ক্বাসেম ইবনে মুহাম্মাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করল এবং বলল, ছালাতের মধ্যে আমার (ভুলের) সন্দেহ হয়। এটা আমার পক্ষে বড় কষ্টদায়ক হয়। (পরবর্তী রাবী বলেন) ক্বাসেম (রাঃ) উত্তরে বললেন, (এটা শয়তানের কাজ, এর প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে) তুমি তোমার ছালাত পূর্ণ করতে থাকবে। কেননা এটা তোমা হতে দূর হবে না, যে পর্যন্ত না ছালাত পূর্ণ কর এবং বল যে, আমি ছালাত পূর্ণ করিনি।[12] এ হাদীছে বুঝা যায়, ছালাত আরম্ভ করলে শয়তান খুব বেশি বেশি কুমন্ত্রণা দেয়, যাতে মুছল্লী বিরক্ত হয়ে ছালাত ছেড়ে দেয়। ছালাত দুই রাক‘আত হয়েছে, না এক রাক‘আত হয়েছে, দুই রাক‘আত হয়েছে, না তিন রাক‘আত হয়েছে, অমুক রাক‘আতে ‘আল-হামদু’ পড়া হয়নি, অমুক রাক‘আতে কিরাআত পড়া হয়নি- এভাবে সে ধোঁকা দেয়। এমনকি এটাও বলে থাকে যে, ছালাতে মন হাযির নেই, এ ছালাতে কী হবে? আবার পড় ইত্যাদি। এটা দূর করার বড় হাতিয়ার হল, এর প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করা এবং শয়তানকে বলা, যাও আমি ছালাত পড়িনি, তাতে কী হল? ভ্রূক্ষেপ করলেই তার বিপদ, শয়তান তাকে আর এগোতে দিবে না। পক্ষান্তরে এর প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করলে শয়তান নিজেই বিরক্ত হয়ে সরে দাঁড়াবে।
হাদীছ নং ৯:
عَنْ صَفِيَّةَ بِنْتِ حُيَيٍّ قَالَتْ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ مُعْتَكِفًا فَأَتَيْتُهُ أَزُوْرُهُ لَيْلاً فَحَدَّثْتُهُ ثُمَّ قُمْتُ فَانْقَلَبْتُ فَقَامَ مَعِيْ لِيَقْلِبَنِيْ وَكَانَ مَسْكَنُهَا فِيْ دَارِ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ فَمَرَّ رَجُلَانِ مِنَ الْأَنْصَارِ فَلَمَّا رَأَيَا النَّبِيَّ أَسْرَعَا فَقَالَ النَّبِيُّ عَلَى رِسْلِكُمَا إِنَّهَا صَفِيَّةُ بِنْتُ حُيَيٍّ فَقَالَا سُبْحَانَ اللهِ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَجْرِيْ مِنْ الْإِنْسَانِ مَجْرَى الدَّمِ وَإِنِّيْ خَشِيْتُ أَنْ يَقْذِفَ فِيْ قُلُوْبِكُمَا سُوْءًا أَوْ قَالَ شَيْئًا-
ছাফিয়্যাহ বিনতে হুয়াই (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ই‘তিকাফ অবস্থায় ছিলেন। আমি রাতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসলাম। এরপর তাঁর সঙ্গে কিছু কথা বললাম। অতঃপর আমি ফিরে আসার জন্য দাঁড়ালাম। তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ও আমাকে পৌঁছে দেয়ার জন্য আমার সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন আর তাঁর বাসস্থান ছিল উসামাহ ইবনু যায়েদ (রাঃ)-এর বাড়ীতে। এ সময় দু’জন আনছারী সে স্থান দিয়ে অতিক্রম করল। তারা যখন নবী করীম (ছাঃ)-কে দেখল, তখন তারা শীঘ্র চলে যেতে লাগল। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তোমরা একটু থামো। এ হচ্ছে ছাফিয়্যাহ বিনতু হুয়াই (রাঃ)। তারা বললেন, সুবহানাল্লাহ! হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, ‘মানুষের রক্তধারায় শয়তান প্রবহমান থাকে। আমি শঙ্কাবোধ করছিলাম, সে তোমাদের মনে কোন খারাপ ধারণা অথবা বললেন অন্য কিছু সৃষ্টি করে নাকি’।[13] এ হাদীছ দ্বারা শয়তানের ক্ষমতা বুঝা যায়। নবী (ছাঃ)-এর স্ত্রীর ব্যাপারেও যদি শয়তান মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দিতে পারে যে, নবী (ছাঃ)-এর স্ত্রী না অন্য কোন মহিলা। অর্থাৎ শয়তান নবী (ছাঃ)-এর ব্যাপারেও মানুষের অন্তরে কুমন্ত্রণা দিতে পারে। তাহলে অন্য মানুষের অন্তরে তো সহজেই কুমন্ত্রণা দিতে পারে। শয়তান থেকে সাবধান থাকার ব্যাপারে নবী করীম (ছাঃ) এ সতর্কবাণী করেছেন, যা আমাদের সকলের জন্য একান্ত যরূরী বিষয়।
হাদীছ নং ১০:
عَنْ عَاصِمٍ سَمِعْتُ أَبَا تَمِيْمَةَ يُحَدِّثُ عَنْ رَدِيْفِ رَسُوْلِ اللهِ قَالَ عَثَرَ بِالنَّبِيِّ حِمَارُهُ فَقُلْتُ تَعِسَ الشَّيْطَانُ فَقَالَ النَّبِيُّ لَا تَقُلْ تَعِسَ الشَّيْطَانُ فَإِنَّكَ إِذَا قُلْتَ تَعِسَ الشَّيْطَانُ تَعَاظَمَ وَقَالَ بِقُوَّتِيْ صَرَعْتُهُ وَإِذَا قُلْتَ بِسْمِ اللهِ تَصَاغَرَ حَتَّى يَصِيْرَ مِثْلَ الذُّبَابِ-
আছিম (রাঃ) বলেন, আমি আবু তামীমা (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি গাধার পিঠে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পিছনে বসেছিলেন। তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ)-কে নিয়ে তাঁর গাধাটি হোঁচট খেল, তখন আমি বললাম, শয়তান ধ্বংস হোক। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘এভাবে বল না, এতে শয়তান আরো বড় হয়ে যায়, আরো এগিয়ে আসে এবং বলে, আমি নিজের শক্তি দ্বারা তাকে ফেলে দিয়েছি। আর যদি বিসমিল্লাহ বল, তাহলে সে ছোট হতে হতে মাছির মত হয়ে যায়’।[14] এ হাদীছে বুঝা যায়, কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেলে শয়তান ঘটিয়েছে একথা বলা যাবে না। কেননা তাতে শয়তান মনে করে আমি দুর্ঘটনা ঘটাতে পারি। তাতে তার অহঙ্কার বেড়ে যায়। কাজেই এ সময় ‘বিসমিল্লাহ’ অথবা ‘ইন্না লিল্লাহি…’ বলতে হবে। তাহলে শয়তান অপমাণিত হয়ে যায় এবং নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করে।
হাদীছ নং ১১:
عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا كَانَ فِي الْمَسْجِدِ جَاءَهُ الشَّيْطَانُ فَأَبَسَ بِهِ كَمَا يَأْبِسُ الرَّجُلُ بِدَابَّتِهِ فَإِذَا سَكَنَ لَهُ زَنَقَهُ أَوْ أَلْجَمَهُ قَالَ أَبُوْ هُرَيْرَةَ فَأَنْتُمْ تَرَوْنَ ذَلِكَ أَمَّا الْمَزْنُوْقُ فَتَرَاهُ مَائِلًا كَذَا لَا يَذْكُرُ اللهَ وَأَمَّا الْمَلْجُوْمُ فَفَاتِحٌ فَاهُ لَا يَذْكُرُ اللهَ-
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের কোন ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করলে শয়তান তার কাছে যায় এবং আদর করে তার গায়ে হাত বুলাতে থাকে যেমন মানুষ গৃহপালিত পশুর গায়ে হাত বুলায়। ঐ আদরে লোকটি চুপ করে থাকলে শয়তান তার নাকে দড়ি বা মুখে লাগাম পরিয়ে দেয়’। আবু হুরায়রা (রাঃ) এ হাদীছটি বর্ণনা করার পর বলেন, আপনারা স্বয়ং নাকে দড়ি লাগানো এবং মুখে লাগাম পরিহিত লোককে দেখতে পাবেন। নাকে দড়ি লাগানো হল ঐ ব্যক্তি, যে এক দিকে ঝুকে দাঁড়িয়ে থাকে এবং আল্লাহকে স্মরণ করে না। আর মুখে লাগাম পরিহিত হল ঐ ব্যক্তি, যে মুখ খুলে রাখে এবং আল্লাহর যিকির করে না’।[15] এ হাদীছে বুঝা যায়, মানুষ মসজিদে ঢুকলেই শয়তান তাকে চেপে ধরে এবং তার গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে যিকির-আযকার হতে ফিরিয়ে দেয়। তারপর তার নাকে দড়ি লাগিয়ে দেয় এবং মুখে লাগাম পরিয়ে দেয়, তখন সে আর যিকির-আযকার করে না; বরং ঘুমিয়ে পড়ে অথবা অমনোযোগী হয় অথবা মানুষের সাথে গল্পে লিপ্ত হয়ে যায়। তখন শয়তান নিজেকে সফল মনে করে। মানুষের জন্য যরূরী কর্তব্য হল, সবসময় শয়তান থেকে সবধান থাকবে, বিশেষভাবে মসজিদে প্রবেশ করলে আরো বেশি সর্তক ও সাবধান হতে হবে।
আল্লাহ আমাদেরকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করুন। আমীন!
[1]. মুমিনূন, ৯৭-৯৮।
[2]. ইবনু মাজাহ, হা/৮০৮।
[3]. আবুদাঊদ, হা/৪৭৮১।
[4]. ছহীহ মুসলিম, হা/১৩৪; ছহীহ আল-জামে‘, হা/৭৬৯৬; মিশকাত, হা/৬৬।
[5]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৩৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২১৭৪; মিশকাত, হা/৬৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/৬২।
[6]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮১৪; মিশকাত, হা/৬৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/৬১।
[7]. ছহীহ বুখারী, হা/৩৪৩১; ছহীহ মুসলিম, হা/২৩৬৬; মিশকাত, হা/৬৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/৬৩।
[8]. ছহীহ বুখারী, হা/২০৩৮; ছহীহ মুসলিম, হা/২১৭৪; মিশকাত, হা/৬৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/৬৪।
[9]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮১৩; মিশকাত, হা/৭১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/৬৫।
[10]. ছহীহ মুসলিম, হা/২৮১২; মিশকাত, হা/৭২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/৬৬।
[11]. ছহীহ মুসলিম, হা/ ২২০৩; মিশকাত, হা/৭৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/৭১।
[12]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, হা/৩৩২; মিশকাত, হা/৭৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত, হা/৭২।
[13]. ছহীহ বুখারী, হা/৩২৮১; ছহীহ মুসলিম, হা/২১৭৫; আবুদাঊদ, হা/২৪৭২।
[14]. মুসনাদে আহমাদ, হা/২০৬১০।
১৫. মুসনাদে আহমাদ, হা/৮৩৫২।
Leave a Reply