আল্লাহ সর্বশক্তিমান
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
আল্লাহ বলেন,تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ- الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلاً وَّهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ- ‘বরকতময় তিনি, যাঁর হাতেই সকল রাজত্ব। আর তিনি সকল কিছুর উপরে সর্বশক্তিমান’। ‘যিনি মৃত্যু ও জীবনকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য, কে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর আমল করে? আর তিনি মহাপরাক্রান্ত ও ক্ষমাশীল’ (মুল্ক ৬৭/১-২)।
ফযীলত :
(১) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,إِنَّ سُورَةً فِي الْقُرْآنِ ثَلاَثُونَ آيَةً شَفَعَتْ لِرَجُلٍ حَتَّى غُفِرَ لَهُ وَهِيَ تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ- ‘কুরআনে ৩০ আয়াত বিশিষ্ট একটি সূরা আছে, যা তার পাঠক এক ব্যক্তির জন্য সুফারিশ করেছে। ফলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। সেটি হ’ল تَبَارَكَ الَّذِى بِيَدِهِ الْمُلْكُ، (সূরা মুল্ক)।[1] অর্থাৎ ঐ ব্যক্তি পূর্ণ অনুধাবনের সাথে সূরা মুল্ক পাঠ করেছিল ও এর উচ্চ মর্যাদা উপলব্ধি করেছিল। ফলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন ও তার কবরের আযাব মাফ করেছেন। এটি ভবিষ্যতের অর্থে নিলে যে ব্যক্তি এটি পাঠ করবে, সে ব্যক্তি অনুরূপ মর্যাদা প্রাপ্ত হবে।
উল্লেখ্য যে, যারা ‘বিসমিল্লাহ’-কে সূরা ফাতেহার অংশ বলেন না, অত্র হাদীছটি তার অন্যতম দলীল। কেননা সূরা মুল্কে ৩০ টি আয়াত রয়েছে বিসমিল্লাহ ব্যতীত (মিরক্বাত)। অত্র হাদীছে আরেকটি বিষয় জানা যায় যে, কোন আয়াত নাযিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর হুকুমে যথাস্থানে তার তারতীব দেওয়া হ’ত এবং কুরআনের সূরা ও আয়াত সমূহের তারতীব সম্পূর্ণরূপে তাওক্বীফী। অর্থাৎ আল্লাহর হুকুমে জিব্রীল মারফত রাসূল (ছাঃ) কর্তৃক সম্পাদিত হ’ত। এতে কোনরূপ কমবেশী বা আগপিছ করার অধিকার কারু ছিলনা (কুরতুবী)।
(২) আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, هِىَ الْمَانِعَةُ هِىَ الْمُنْجِيَةُ تُنْجِيهِ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ ‘সূরাটি হ’ল বাধা দানকারী ও মুক্তি দানকারী। যা এর পাঠকারীকে কবর আযাব হ’তে মুক্তি দেয়’।[2]
(৩) হযরত জাবের (রাঃ) বলেন,كَانَ لاَ يَنَامُ حَتَّى يَقْرَأَ الۤمۤ، تَنْزِيلُ وَتَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ- রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিদ্রা যেতেন না যতক্ষণ না তিনি সূরা সাজদাহ ও সূরা মুল্ক পাঠ করতেন।[3] অর্থাৎ অন্যান্য সূরার সাথে এ দু’টি সূরা পাঠ করাও তাঁর অভ্যাসের মধ্যে ছিল (মিরক্বাত)।
সূরার শুরুতে تَبَارَكَ الَّذِي، ‘বরকতময় তিনি’ বলার মাধ্যমে আল্লাহর শরীকহীনতাকে সর্বাগ্রে আনা হয়েছে। যা শিরকে অভ্যস্ত মক্কাবাসীদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের বুকে তীব্র আঘাত হানে। যুগে যুগে সকল অবিশ্বাসী ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে এটি প্রতিবাদ স্বরূপ।
الْبَرَكَةُ মাছদার থেকে بَاب تَفَاعُلٌ থেকে تَفَاعَلَ-এর ওযনে تَبَارَكَ আনা হয়েছে এটা বুঝানোর জন্য যে, তাঁর বরকতময় সত্তা শাশ্বত (قَدِيْمٌ)। বলা হয়েছে যে, تَبَارَكَ অর্থ دَامَ ‘চিরন্তন’। যার অস্তিত্বের কোন আদি বা অন্ত নেই (কুরতুবী)। তাঁর হাতেই সকল রাজত্ব দুনিয়া ও আখেরাতে। মুল্ক ও মালাকূত তথা দৈহিক ও আত্মিক জগতের একচ্ছত্র মালিকানা তাঁর হাতে। যেমন অত্র আয়াতে ‘মুল্ক’ (بِيَدِهِ الْمُلْكُ) বলা হয়েছে এবং অন্য আয়াতে ‘মালাকূত’(بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ) (ইয়াসীন ৩৬/৮৩) বলা হয়েছে। যার দ্বারা দৃশ্যমান ও অদৃশ্য এবং দৈহিক ও আত্মিক উভয় জগতের সর্বময় ক্ষমতা তাঁর হাতে বুঝানো হয়েছে (ক্বাসেমী)। অনস্তিত্ব ও অস্তিত্ব জগতের সবকিছুর মালিকানা, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা এককভাবে আল্লাহর হাতে। তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি বরকতময় ও সর্বশক্তিমান।
بِيَدِهِ الْمُلْكُ، এর ব্যাখ্যায় আল্লামা যামাখশারী (৪৬৭-৫৩৮ হি.) বলেন,وَذِكْرُ الْيَدِ مَجَازٌ عَنِ الْإِحَاطَةِ بِالْمُلْكِ وَالْإسْتِيلاَءِ عَلَيْهِ- ‘তাঁর হাতে বলে রূপক অর্থে রাজত্বকে বেষ্টন করা ও তার উপর কর্তৃত্ব করা বুঝানো হয়েছে’ (কাশশাফ)। অথচ আহলে সুন্নাতের আক্বীদা অনুযায়ী ‘আল্লাহর হাত’-এর প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ করতে হবে। যা তাঁর উপযোগী এবং যা অন্য কারু সাথে তুলনীয় নয়’ (শূরা ৪২/১১)। তিনি ‘মৃত্যু’র ব্যাখ্যা দিয়েছেন ‘অস্তিত্বহীন’ (عَدَم) বলে। যা ভ্রান্ত ফিরক্বা ক্বাদারিয়াদের অনুসরণ। অথচ আহলে সুন্নাতের আক্বীদা মতে মৃত্যু হ’ল অস্তিত্ব জগতের বিষয় (أَمْرٌ وُجُوْدِيٌّ), যা জীবনের বিপরীত। যদি মৃত্যুকে অস্তিত্বহীন বলা হয়, তাহ’লে পুরা সৃষ্টিজগতই অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে। যা অগ্রহণযোগ্য (মুহাক্কিক কাশশাফ)। অর্থাৎ জন্মের মাধ্যমে অস্তিত্বে আসার পর সে মৃত্যুর মাধ্যমে অস্তিত্বহীন হবে। জন্মের আগে থেকে নয়।
একইভাবে জালালায়েন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, بِيَدِهِ ‘তাঁর হাতে’ অর্থ فِي تَصَرُّفِهِ ‘তাঁর পরিচালনায়’। এর মাধ্যমে আল্লাহর ‘হাত’ গুণকে অস্বীকার করা হয়েছে এবং প্রকাশ্য অর্থ পরিবর্তন করা হয়েছে। এটি সালাফে ছালেহীনের বুঝের বিপরীত।
বায়যাভী (৫৯৪-৬৮৫ হি.) ব্যাখ্যা করেছেন,بِقَبْضَةِ قُدْرَتِهِ التَّصَرُّفُ فِي الْأُمُورِ كُلِّهَا- ‘যার শক্তির অধিকারে রয়েছে সকল কর্মের পরিচালনা’ (বায়যাভী)।
একইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন আল্লামা শাওকানী (১১৭৩-১২৫৫ হি.)। তিনি বলেছেন,وَالْيَدُ مَجَازٌ عَنِ الْقُدْرَةِ وَالِإسْتِيلاَءِ- ‘হাত বলা হয়েছে শক্তি ও প্রতিপত্তির রূপক অর্থে’ (ফাৎহুল ক্বাদীর)। এখানেও আল্লাহর ‘হাত’ গুণকে অস্বীকার করা হয়েছে। যা ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝের বিপরীত। যেমন জ্যেষ্ঠতম মুফাসসির ইবনু জারীর ত্বাবারী (২২৪-৩১০ হি.) ব্যাখ্যা করেছেন,بِيَدِهِ مُلْكُ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَسُلْطَانُهُمَا نَافِذٌ فِيهِمَا أَمْرُهُ وَقَضَاؤُهُ- ‘তাঁর হাতেই দুনিয়া ও আখেরাতের রাজত্ব ও কর্তৃত্ব। যার মধ্যেই তাঁর আদেশ ও সিদ্ধান্ত সমূহ বাস্তবায়িত হয়’ (ত্বাবারী)।
ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হি.) বলেছেন,هُوَ الْمُتَصَرِّفُ فِي جَمِيعِ الْمَخْلُوقَاتِ بِمَا يَشَآءُ- ‘তিনি সমগ্র সৃষ্টিজগতের পরিচালক, যেভাবে তিনি চান’ (ইবনু কাছীর)।
ক্বাসেমী (১২৮৩-১৩৩২ হি.) প্রথমে ইবনু জারীরের ব্যাখ্যাটি এনেছেন, অতঃপর বলেছেন,فَبِيَدِهِ كُلُّ مَا وُجِدَ مِنَ الْأَجْسَامِ، لاَ بِيَدِ غَيْرِهِ، يُصَرِّفُهَا كَمَا يَشَآءُ، ‘অতএব তাঁর হাতেই রয়েছে সকল শরীরী বস্ত্ত, অন্যের হাতে নয়। তিনি যেভাবে চান সেভাবে সেগুলি পরিচালনা করেন’ (ক্বাসেমী)।
আব্দুর রহমান নাছের আস-সা‘দী (১৩০৭-১৩৭৬ হি.) বলেন, أَنَّ بِيَدِهِ مُلْكَ الْعَالَمِ الْعُلْوِيِّ وَالسُّفْلِيِّ ‘তাঁর অনুগ্রহ ও বড়ত্ব সর্বত্র পরিব্যপ্ত একারণে যে, তাঁর হাতেই রয়েছে উপরের ও নীচের রাজত্ব’ (সা‘দী)। আবুবকর জাবের আল-জাযায়েরী (১৩৩৯-১৪৩৯ হি.) বলেন,الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ أَجْمَعَ مُلْكاً وَتَصَرُّفًا وَتَدْبِيْراً ‘যার হাতে রয়েছে শাসন, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার সর্বময় ক্ষমতা সহ পুরাপুরি রাজত্ব’ (আয়সারুত তাফাসীর)।
وَهُوَ عَلٰى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ- ‘আর তিনি সকল কিছুর উপরে সর্বশক্তিমান’। অর্থাৎ ‘পুরস্কার ও শাস্তি দানের ব্যাপারে তিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী’ (কুরতুবী)।
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ ‘যিনি মৃত্যু ও জীবনকে সৃষ্টি করেছেন’।
অত্র আয়াতে মৃত্যুকে আগে আনা হয়েছে তা থেকে সাবধান হওয়ার জন্য এবং পাপ হ’তে বিরত থেকে পরকালের পাথেয় সঞ্চয়ে ব্রতী হওয়ার জন্য। দ্বিতীয়তঃ এটা বুঝানোর জন্য যে, অনস্তিত্বই হ’ল মূল। সেখান থেকে জীবন পেয়ে অস্তিত্ববান হওয়াটা নিতান্তই আল্লাহর ইচ্ছা। এতে অন্য কারু কোন হাত নেই (ক্বাসেমী)। সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহ বলেন, هَلْ أَتَى عَلَى الْإِنْسَانِ حِينٌ مِّنَ الدَّهْرِ لَمْ يَكُنْ شَيْئًا مَّذْكُورًا- ‘নিশ্চয়ই মানুষের উপর যুগের এমন একটি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, যখন সে উল্লেখ করার মত কিছুই ছিল না’ (দাহর ৭৬/১)। অথবা ‘মৃত্যু’ দ্বারা দুনিয়া এবং ‘জীবন’ দ্বারা আখেরাতকে বুঝানো হয়েছে। কেননা দুনিয়াতে মানুষ মরবেই। কিন্তু আখেরাতে কোন মৃত্যু নেই (কুরতুবী)।
এখানে আরেকটি সূক্ষ্ম বিষয় লক্ষণীয় যে, এখানে আল্লাহ ‘মৃত্যুকে সৃষ্টি করেছেন’ বলার মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, কেবল তাঁর মৃত্যু নেই। যার ব্যাখ্যায় তিনি অন্যত্র বলেন, كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلاَّ وَجْهَهُ، لَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ- ‘প্রত্যেক বস্ত্তই ধ্বংস হবে কেবল তাঁর চেহারা ব্যতীত। বিধান কেবল তাঁরই এবং তাঁর কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৮)।
لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلاً، ‘তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য, কে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর আমল করে?’ لِيَبْلُوَكُمْ অর্থ لِيَخْتَبِرَكُمْ ‘তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য’ (ত্বাবারী)। أَحْسَنُ عَمَلاً، ‘সুন্দরতম আমল’ বলা হয়েছে حَسَنٌ عَمَلاً ‘সুন্দর আমল’ বলা হয়নি। এর মধ্যে সৎকর্মে সুন্দর হ’তে সুন্দরতম হওয়ার প্রতিযোগিতা করার প্রতি নির্দেশনা রয়েছে। যেমন জান্নাতের ‘তাসনীম’ ঝর্ণার পানি মিশ্রিত মোহরাংকিত শরাব পানের সৌভাগ্য অর্জনে প্রতিযোগিতা করার জন্য আল্লাহ বলেন,خِتَامُهُ مِسْكٌ وَّفِي ذٰلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ- وَمِزَاجُهُ مِنْ تَسْنِيمٍ- ‘তার মোহর হবে মিশকের। আর এরূপ বিষয়েই প্রতিযোগীদের প্রতিযোগিতা করা উচিত’। ‘আর তাতে মিশ্রণ থাকবে তাসনীমের’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/২৬-২৭)।
সর্বশক্তিমানের ধারণা :
বর্তমান পৃথিবীর প্রায় সকল রাষ্ট্র নিজেদেরকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করে। বক্তব্যটি রাষ্ট্রীয় জীবনে তো বটেই, ব্যক্তি জীবনেও সঠিক, এই মর্মে যে, ব্যক্তি বা রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীন। নইলে পুরস্কার ও শাস্তির ব্যবস্থা অমূলক হয়ে যাবে। কিন্তু এর মাধ্যমে যদি কোন ব্যক্তি বা রাষ্ট্র মনে করে যে, সে তার স্বেচ্ছাচারিতায় স্বাধীন; তাহ’লে সেটি ভুল হবে। বরং এটাই সঠিক যে, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীন। রাষ্ট্র এমন কোন আইন প্রণয়ন করতে পারেনা, যা আল্লাহর বিধানের বিপরীত বা তার সাথে সাংঘর্ষিক। যারা ‘জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস’ বলেন, অতঃপর নিজেদেরকে জনগণের প্রতিনিধি হিসাবে যা খুশী আইন করার ও তা বাস্তবায়ন করার অধিকারী মনে করেন, তারা প্রকারান্তরে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করেন। এর ফলে তারা আল্লাহর দাসত্ব হ’তে মুক্ত হয়ে নিজেদের খেয়াল-খুশীর দাসত্ব করেন এবং নাগরিকদের তা মানতে বাধ্য করেন। অথচ আল্লাহ বলেন,أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلاً- ‘তুমি কি তাকে দেখেছ, যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে? তুমি কি তার যিম্মাদার হবে?’ (ফুরক্বান-মাক্কী ২৫/৪৩)।
উক্ত আয়াতটি মক্কার মুশরিক নেতাদের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়েছিল। যারা মূর্তিভাঙা নবী ইব্রাহীমের বংশধর হওয়া সত্ত্বেও নিজেরা মূর্তিপূজা করত। সেই সাথে নিজেদেরকে ইব্রাহীম (আঃ)-এর একান্ত অনুসারী হিসাবে ‘হানীফ’ (একনিষ্ঠ একত্ববাদী), ‘হুম্স’ (কঠোর ধার্মিক), ‘ক্বাত্বীনুল্লাহ’ (আল্লাহর ঘরের খাদেম), ‘আহলুল্লাহ’ (আল্লাহ ওয়ালা), ‘আহলু বায়তিল্লাহ’ (আল্লাহর ঘরের বাসিন্দা) বলে দাবী করত।
আমরাও নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবী করছি। সাথে সাথে মক্কার মুশরিক নেতাদের মত মূর্তিপূজা, আগুনপূজা, স্থানপূজা করে যাচ্ছি। সেই সাথে ইসলাম বিরোধী আইন প্রণয়ন করছি ও নাগরিকদের তা মানতে বাধ্য করছি। আর দোহাই দিচ্ছি গত শতাব্দীতে ১৮৫১ সালে আবিষ্কৃত ‘সেক্যুলারিজম’ বা ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ নামের একটি কুফরী মতবাদের। যা ধর্মহীন চেতনা থেকে উদ্ভূত।
মুসলিম বিশ্বের যেসব শাসক ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন না, তারা খুব সহজে এর ফাঁদে পা দেন। এমনকি এই কুফরী দর্শনের পক্ষে পবিত্র কুরআনকে ব্যবহার করতেও তারা কসুর করেন না। তারা প্রায়ই আপ্ত বাক্যের মত মুক্তকণ্ঠে কুরআনের আয়াতের উদ্ধৃতি দেন, لَكُمْ دِيْنُكُمْ وَلِيَ دِيْنِ- ‘তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন এবং আমার জন্য আমার দ্বীন’ (কাফিরূন ১০৯/৬)। অথচ উক্ত মর্মে কুরআনে আরও আয়াত রয়েছে। তারা দেখেন না যে, বিগত সাড়ে ১৩শ’ বছর যাবৎ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ সহ পৃথিবীর প্রায় দুই তৃতীয়াংশ ভূ-ভাগে ইসলামী খেলাফত তার সোনালী যুগ অতিক্রম করেছে। এই উপমহাদেশেও সাড়ে ছয়শো বছর মুসলমানদের শাসন চলেছে। অথচ মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিকের সর্বোচ্চ মানবাধিকার সর্বদা পূর্ণভাবে রক্ষিত থেকেছে। অমুসলিমদের অধিকার আদৌ ক্ষুণ্ণ করা হয়নি। বরং এটাই দেখা গেছে যে, রাজা মানসিংহ ছিলেন সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি। মোহনলাল ছিলেন নবাব সিরাজুদ্দৌলার অন্যতম সেনাপতি। আর এটা ইসলামী খেলাফতের অন্যতম সৌন্দর্য। কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন যবরদস্তি নেই। নিশ্চয়ই সুপথ ভ্রান্তপথ হ’তে স্পষ্ট হয়ে গেছে’ (বাক্বারাহ ২/২৫৬)। অর্থাৎ ইসলামই কেবল সুপথ এবং বাকী সবই হ’ল ভ্রান্ত পথ।
বস্ত্ততঃ উক্ত আয়াতে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে কোন দলীল নেই। বরং বিপক্ষেই দলীল রয়েছে। কারণ উক্ত আয়াতে মুসলমানদের জন্য অন্য ধর্মের সাথে কোনরূপ আপোষ না করার কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ তাদেরকে এটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, মুসলমানদের পাশাপাশি বসবাস করলেও অমুসলমানেরা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করবে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনভাবেই তাদের কোনরূপ বাধা প্রদান করা হবে না। অবশ্য ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হ’লে সেখানে তারা ইসলামের ফৌজদারী আইন ও হালাল-হারামের বিধানগুলি মেনে চলবেন। যার মধ্যে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। যেমন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সূদ-ঘুষ, জুয়া-লটারী, মওজুদদারী, মুনাফাখোরী ইত্যাদি। অনুরূপ ভাবে সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে চোরের হাত কাটা, খুনের বদলে খুন, ব্যভিচারের কঠোর দন্ড ইত্যাদি। নিঃসন্দেহে রাষ্ট্র যেমন সবার জন্য, আল্লাহর দ্বীনও তেমনি সবার জন্য। যেমন আল্লাহর দেওয়া আলো-বাতাস সবার জন্য সমান। অতএব ধর্মনিরপেক্ষতার মত একটি নাস্তিক্যবাদী দর্শনের পক্ষে এই আয়াতকে দলীল হিসাবে পেশ করা হাস্যকর বৈ-কি!
কথিত ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধর্ম ও বর্ণবৈষম্য, অন্যের মানবাধিকার দলন, চুরি-ডাকাতি, মাদক কারবার, ব্যাপকভাবে দলীয় ও জোটবদ্ধ লুটপাট এবং লোমহর্ষক খুন-ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের যে মর্মান্তিক চিত্র মিডিয়া সমূহের ফাঁক-ফোকর দিয়ে প্রতিদিন বেরিয়ে আসছে, ইসলামী খেলাফতের ইতিহাসে এগুলির কোন নযীর পাওয়া যায় কি?
পরিশেষে বলব, আল্লাহ মুমিনদেরকে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে দাখিল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন (বাক্বারাহ ২/২০৮)। তাঁর বিধানের কিছু অংশ মানা ও কিছু অংশ ছাড়ার ইহূদী স্বভাবের মন্দ পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে, তাদের ফলাফল পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা ব্যতীত কিছুই নেই। আর ক্বিয়ামতের দিন তাদেরকে কঠোরতম শাস্তির দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে উদাসীন নন’ (বাক্বারাহ ২/৮৫)।
আল্লাহ আমাদেরকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন কে সর্বাধিক সুন্দর আমল করে, তা পরীক্ষা করার জন্য। তিনি বলে দিয়েছেন ‘প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের নিকট দায়বদ্ধ’ (মুদ্দাছছির ৭৪/৩৮)। ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলেও তা সে দেখতে পাবে’। ‘আর কেউ অণু পরিমাণ মন্দকর্ম করলেও তা সে দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৯/৭-৮)। অতঃপর বিশ্ববাসীর প্রতি কুরআনের সর্বশেষ নাযিলকৃত আয়াত হ’ল, ‘তোমরা ঐ দিনকে ভয় কর, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর নিকট ফিরিয়ে নেওয়া হবে। অতঃপর সেদিন প্রত্যেকে স্ব স্ব কর্মফল পুরোপুরি প্রাপ্ত হবে এবং তাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৮১)।
وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ-‘আর তিনি মহাপরাক্রান্ত ও ক্ষমাশীল’। অর্থাৎ তিনি পাপাচারীদের থেকে বদলা গ্রহণে পরাক্রান্ত এবং তওবাকারীদের মার্জনা করায় ক্ষমাশীল (কুরতুবী)।
মূলতঃ সূরা মুলকের দ্বিতীয় আয়াতের এই শেষাংশের মধ্যেই আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বাস্তব পরিচয় ফুটে উঠেছে। যার শাস্তি ও ক্ষমাকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা কারু নেই। পাপে ভরা মানব সমাজকে আল্লাহর আনুগত্যে ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি মাঝে-মধ্যে নানাবিধ গযব পাঠিয়ে থাকেন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের মহামারি নিঃসন্দেহে তার অন্যতম গযব। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট মানুষ স্বেচ্ছায় মাথা নত করবে কি?
[1]. তিরমিযী হা/২৮৯১; আবুদাঊদ হা/১৪০০; ইবনু মাজাহ হা/৩৭৮৬; মিশকাত হা/২১৫৩; ছহীহুল জামে‘ হা/২০৯১।
[2]. তিরমিযী হা/২৮৯০; ত্বাবারাণী কাবীর হা/১২৮০১; মিশকাত হা/২১৫৪; ছহীহাহ হা/১১৪০, হাদীছটির শেষাংশ যা উপরে বর্ণিত হয়েছে, এটুকু ছহীহ। প্রথমাংশটি যঈফ (আলবানী, ঐ)।
[3]. তিরমিযী হা/২৮৯২; আহমাদ হা/১৪৭০০; মিশকাত হা/২১৫৫; ছহীহাহ হা/৫৮৫।