জাকির আব্দুল করিম নায়েক (ইংরেজি: Zakir Naik; উর্দু: ذاکر نائیک; জন্মঃ ১৮ অক্টোবর ১৯৬৫; মুম্বাই, ভারত) হলেন একজন ভারতীয় ইসলামি চিন্তাবিদ, ধর্মপ্রচারক, বক্তা ও লেখক যিনি ইসলাম ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে কাজ করেন।[১৭][১৮] তিনি ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন নামক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা যেটি পিস টিভি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে থাকে,[১৯][২০][২১] যার মাধ্যমে তাঁর বক্তৃতা প্রায় দশ কোটি দর্শকের নিকট পৌঁছে যায়।[২২][২৩] তাকে “তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের একজন বিশেষজ্ঞ”,[২৪] “অনুমেয়ভাবে ভারতের সালাফি মতাদর্শের অনুসারী সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি”[২৫], “টেলিভিশনভিত্তিক-ধর্মপ্রচারণার রকস্টার এবং আধুনিক ইসলামের একজন পৃষ্ঠপোষক”[১৯] এবং “পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় ইসলাম ধর্মপ্রচারক” বলা হয়ে থাকে।[২২] বহু ইসলামি ধর্মপ্রচারকদের সাথে তার ভিন্নতা হল, তার বক্তৃতাগুলো পারস্পারিক আলাপচারিতা ও প্রশ্নোত্তরভিত্তিক,[২৬] যা তিনি আরবি কিংবা উর্দুতে নয় বরং ইংরেজি ভাষায় প্রদান করেন,[২২] এবং অধিকাংশ সময়েই তিনি ঐতিহ্যগত আলখাল্লার পরিবর্তে স্যুট-টাই পরিধান করে থাকেন।[২৬]
পেশাগত জীবনে তিনি একজন ডাক্তার হলেও ১৯৯১ সাল থেকে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন।[১৮] ইসলাম এবং তুলনামূলক ধর্মের উপর তিনি তার বক্তৃতার বহু পুস্তিকা সংস্করণ প্রকাশ করেছেন। যদিও প্রকাশ্যে তিনি ইসলামে শ্রেণীবিভাজনকে অস্বীকার করে থাকেন, তবুও অনেকে তাকে সালাফি মতাদর্শের সমর্থক বলে মনে করেন,[৭][২৭] এবং অনেকে তাঁকে ওয়াহাবি মতবাদ প্রচারকারী একজন আমূল-সংস্কারবাদী[২৮] ইসলামিক “টেলিভেগানিস্ট” বা “তহবিল সংগ্রহকারী টেলিভিশন ধর্মপ্রচারক” বলেও মনে করে থাকেন।[১০][১১][২২][২৯][৩০][৩১] বর্তমানে ভারত, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে তার ধর্মপ্রচার নিষিদ্ধ।[৩২][৩৩][৩৪] বলা হয়ে থাকে যে, মুসলিম সম্প্রদায়ের বাইরের তুলনায় এর ভেতরেই তাঁর সমালোচকের সংখ্যা বেশি।[৩৪]
জাকির আবদুল করিম নায়েক ১৮ অক্টোবর ১৯৬৫ সালে ভারতের মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মুম্বাইয়ের সেন্ট পিটার্স হাই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। এরপর তিনি কিশিনচাঁদ চেল্লারাম কলেজে ভর্তি হন। তিনি মেডিসিনের ওপর টোপিওয়ালা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড নাইর হসপিটালে ভর্তি হন। অতঃপর, তিনি ইউনিভার্সিটি অফ মুম্বাই থেকে ব্যাচেলর অব মেডিসিন সার্জারি বা এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন।[২০][৩৫]
১৯৯১ সালে তিনি ইসলাম-ধর্ম প্রচারের কার্যক্রম শুরু করেন এবং আইআরএফ প্রতিষ্ঠা করেন।[৩৬] নায়েকের স্ত্রী, ফারহাত নায়েক, ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নারীদের শাখায় কাজ করেন।[১][৩]
ডাঃ জাকির বলেন তিনি আহমেদ দিদাতের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন, যার সাথে তিনি ১৯৮৭ সালে সাক্ষাত করেন।[৩৭] ডাঃ জাকিরকে অনেক সময় ‘‘দিদাত প্লাস’’ বলা হয়, এই উপাধি দিদাত নিজে দেন।[৩৭][৩৮]
এছাড়াও তিনি মুম্বাইয়ের ইসলামিক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল[৩৯] এবং ইউনাইটেড ইসলামিক এইডের প্রতিষ্ঠাতা, যা দরিদ্র ও অসহায় মুসলিম তরুণ-তরুণীদের বৃত্তি প্রদান করে থাকে।[৪০]
ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে তাকে “পিস টিভি নেটওয়ার্কের পৃষ্ঠপোষক ও আদর্শিক চালিকাশক্তি” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।[৪১] যে চ্যানেলটি “সমগ্র মানবতার জন্য সত্য, ন্যায়বিচার, নৈতিকতা, সৌহার্দ্য ও জ্ঞানের” প্রচারের লক্ষ্যে কাজ করে বলে এর ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে।[৩৪]
২০১৬ সালে, একটি প্রেস কনফারেন্সে, জাকির নিজেকে নন-রেজিস্ট্যান্ট ইন্ডিয়ান (এনআরআই) বা বছরের অর্ধেকের বেশি সময় প্রবাসে বসবাসকারী ভারতীয় হিসেবে দাবি করেন।[৪২][৪৩]
নায়েক বর্তমানে মালেশিয়ায় স্থায়ী নাগরিকত্ব নিয়ে বসবাস করছেন।[৪৪]
জাকির নায়েক ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত অনেক বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন ও বিতর্ক করেছেন। তিনি বক্তৃতার মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয় কোরআন ও হাদীসের আলোকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইসলামের অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন।। নৃতত্ত্ববিদ থমাস ব্লম হানসেন লিখেছেন যে, ডাঃ জাকিরের বিভিন্ন ভাষায় কুরআন ও হাদিস সাহিত্য মনে রাখার ভঙ্গী ও তার ধর্মপ্রচার কর্মকাণ্ড মুসলিমদের মাঝে তাকে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করে তুলেছে।[৪৫] তার অনেক বিতর্ক রেকর্ড করা হয় এবং ভিডিও, ডিভিডি আকারে ও অনলাইনে বিস্তৃত পরিসরে বিতরণ করা হয়। তার আলোচনা ইংরেজিতে রেকর্ড করা হয়ে থাকে এবং সপ্তাহ শেষে মুম্বাইয়ের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোর বিভিন্ন ক্যাবল নেটওয়ার্কে এবং তার নিজস্ব প্রযোজনাধীন পিস টিভি চ্যানেলে সম্প্রচারিত হয়।[৪৬][৪৭] তার আলোচনার বিষয়বস্তুগুলোর মধ্যে কয়েকটি হল: “ইসলাম ও আধুনিক বিজ্ঞান“, “ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম“, এবং “ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ“।
তার প্রথম বিতর্ক হয় ১৯৯৪ সালে, বাংলাদেশী লেখিকা তসলিমা নাসরিনের “লজ্জা” নামক বইকে কেন্দ্র করে মুম্বাই মারাঠি পত্রাকর সংঘ কর্তৃক আয়োজিত একটি বিতর্ক, যার শিরোনাম ছিল “ধর্মীয় মৌলবাদ কি মত-প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য বাধাস্বরূপ?”।[৪৮][৪৯] চারজন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে কয়েকঘণ্টা ব্যাপী এই বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে জাকির বইটি থেকে ইসলামকেন্দ্রিক বিভিন্ন উদ্ধৃতিকে ভুল ব্যাখ্যা ও বিভ্রান্তি হিসেবে দাবি করে বক্তব্য দেন এবং তা সবার নজর কেড়ে নেয়।[৪৮][৫০][৫১] তার অন্যতম বিখ্যাত বিতর্ক হয় ২০০০ সালের এপ্রিলে ‘বিজ্ঞানের আলোয় কুরআন ও বাইবেল’ বিষয়ে শিকাগোতে উইলিয়াম ক্যাম্পবেলের সাথে।[৫২] তিনি বলেন, ‘ইসলাম একটি কার্যকারণ ও যুক্তির ধর্ম এবং কুরআনে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রায় ১০০০ আয়াত আছে।’ সেখানে তিনি পশ্চিমা কনভার্টের সংখ্যা ব্যাখ্যা করেন।[৫৩] জাকিরের অন্যতম জনপ্রিয় থিম হল বিজ্ঞানের সূত্র দিয়ে কোরআনকে যাচাই করা।[৫৪] ২১ জানুয়ারি ২০০৬ জাকির শ্রী শ্রী রবিশঙ্করের সাথে ‘ইসলাম ও হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর’ বিষয়ে ব্যাঙ্গালোরে বিতর্ক করেন।[৫৫] ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে, নায়েক ভারত থেকে সরাসরি ভিডিও লিংকের মাধ্যমে অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সঙ্গে কথোপকথন করেন।[৫৬]
নভেম্বর ২০০৭ থেকে জাকির প্রতিবছর মুম্বাইতে সিয়নের সুমাইয়া গ্রাউন্ডে একটি ১০-দিনের শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করে আসছেন। সেখানে নায়েকসহ আরও বিশজন ইসলামী বক্তা ইসলামের উপর বক্তব্য উপস্থাপন করে থাকেন।[৫৭]
‘‘শুধু ইসলামই নারীকে সমতা দেয়’’-এ বিষয়ে জাকির ২০০৪ সালে ‘ইসলামিক ইনফরমেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস নেটওয়ার্ক অফ অস্ট্রেলিয়া’-এর আমন্ত্রণে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে বিতর্ক করেন।[৫৮] তিনি বলেন যে, ‘পশ্চিমা পোশাক মেয়েদের ধর্ষণের অন্যতম কারণ।[৫৯] কারণ, এটা মেয়েদেরকে পর-পুরুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে।’ দ্য এজ পত্রিকার সুশি দাস মন্তব্য করেন, “নায়েক ইসলামের উপদেশের ও আত্মিক শ্রেষ্ঠত্বের উচ্চ প্রশংসা করেন এবং পশ্চিমা বিশ্বে সাধারণ ভাবে যে বিশ্বাস দেখা যায় তাকে ব্যাঙ্গ করেন।”[৬০]
ডঃ নায়েককে ২০১০-এর জুন মাসে যুক্তরাজ্যে ও কানাডায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।[৬১][৬২] মুসলিম কানাডিয়ান কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা তারেক ফাতাহ জাকির নায়েকের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সেদেশের সাংসদের সতর্ক করার পর কানাডায় তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।[৬২] লন্ডন এবং শেফফিল্ডে তার বক্তৃতা আয়োজনের পর স্বরাষ্ট্র সচিব থেরেসা মে তার যুক্তরাজ্যে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। [৬৩] মে নিষেধাজ্ঞার রায়ে বলেন, “জাকির নায়েকের অসংখ্য মন্তব্য তার অগ্রহণযোগ্য আচরণের প্রমাণ হিসেবে আমার কাছে আছে।”[৬১] নায়েক দাবি করেন যে, স্বরাষ্ট্র সচিব একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, কোন নৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, এবং তার আইনজীবী বলেন যে এই সিদ্ধান্তটি ছিল বর্বর এবং অমানবিক। তিনি আরও দাবি করেন যে তার মন্তব্যকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে।[৬৪] চলচ্চিত্র নির্মাতা মহেশ ভাট নায়েককে সমর্থন জানিয়ে বলেন যে, এই নিষেধাজ্ঞাটি বাক-স্বাধীনতার উপর একটি আক্রমণস্বরূপ।[৬৫] বলা হয়েছিল, নায়েক উচ্চ আদালতের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করার ব্যবস্থা নেবেন।[৬৬] তার আইনি পুনর্বিবেচনার এই আবেদনটি ২০১০-এর ৫ই নভেম্বর খারিজ করে দেওয়া হয়।[৩৬]
২০১৪ সালে, নায়েক গাম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া জাম্মেহর আমন্ত্রণে গাম্বিয়া সফর করেন।[২][৬৭] সেখানে ১১-২২ অক্টোবরের মধ্যে তিনি চারটি বক্তৃতা প্রদান করেন।[২][৬৭][৬৮][৬৯] বক্তৃতাগুলো গাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, প্যারাডাইস সুটস হোটেল, কানালাই এবং কলইয়ের কাইরাবা বিচ হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রীয় ক্যাবিনেট মন্ত্রীগণ, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, ছাত্রছাত্রী এবং সহস্র দর্শক তার বক্তৃতা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।[৬৭][৬৯] এর পাশাপাশি, তিনি রাষ্ট্রপতি ও গাম্বিয়া সুপ্রিম ইসলামী কাউন্সিলের সঙ্গে পৃথক সাক্ষাৎ করেন এবং গাম্বিয়ার ইমামদের সঙ্গে একটি ইসলামী আলোচনা সভায় অংশ নেন।[৬৭][৬৮]
২০১২ সালে নায়েক মালয়েশিয়ায় মারা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জহর বারু, কুয়ান্তান ও পুত্রা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বক্তৃতা দেন।[৭০] হিন্দ অধিকার সংগ্রাম শক্তির (HINDRAF) সদস্যদের প্রতিবাদের পরও মালয়েশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং প্রায় কয়েক হাজার লোক বিভিন্ন স্থানে তার বক্তৃতায় উপস্থিত ছিলেন।[৭১] নায়েকের বক্তৃতার আয়োজকগণ বলেন যে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য প্রচার করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল।[৭২] ২০১৬ সালের ৯-২০ এপ্রিল নায়েক মালয়েশিয়ায় আরও ছয়টি বক্তৃতা প্রদান করেন।[৭৩][৭৪] হিন্দরাফ ও কিছু স্থানীয় এনজিও সংস্থা সেখানে তার “ইসলাম ও হিন্দুধর্মের সাদৃশ্য” এবং”কুরআন কি ঈশ্বরের বানী” নামক দুটি বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে অভিযোগ করেছিল যে এটি আন্তঃধর্মীয় উত্তেজনা বৃদ্ধিতে উস্কানিমূলক হতে পারে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার বক্তৃতাগুলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হয়।[৭৫][৭৬][৭৭]
জাকির বলেন তার লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষিত মুসলমানরা যারা তাদের নিজ ধর্মকে ত্রুটিপূর্ণ, সেকেলে বলে মনে করেন।[৪৫] তিনি মনে করেন, প্রত্যেক মুসলিমের উচিত ইসলাম সম্বন্ধে ভুল ধারণা গুলো ভেঙে দেওয়া এবং পশ্চিমা মিডিয়ার ইসলামের ওপর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বলতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সেপ্টেম্বর ১১, ২০০১-এর আক্রমণ বা নাইন ইলেভেন এর সাজানো নাটককে বোঝান।[৭৮] নায়েক আরও বলেন যে, তীব্র ইসলাম বিরোধী প্রচারণা সত্ত্বেও ২০০১ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে ৩৪,০০০ মার্কিন নাগরিক ইসলাম গ্রহণ করে। নায়েকের ভাষ্য অনুযায়ী, ইসলাম একটি কার্যকারণ ও যুক্তির ধর্ম, এবং কুরআনে বিজ্ঞান সম্পর্কিত ১০০০ বানী রয়েছে, যা তিনি পশ্চিমা ধর্মান্তরিত মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।[৭৯] তার কিছু নিবন্ধ ‘‘‘ইসলামিক ভয়েস’’’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।[৮০]
নায়েক ইসলামকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে দাবি করেন।যা তিনি যুক্তি দিয়ে বহুবার প্রমাণ করেছেন।[৮১] তিনি আরও বলেন, “ইসলামকে অসহনশীল হিসেবে তকমা দেয়া হয়, এটা আসলেই তাই, কিন্তু তা দুর্নীতি, বৈষম্য, অবিচার, ব্যাভিচার, মাদক এবং সকল খারাপ বিষয়বস্তুর প্রতি। ইসলাম হল সবচেয়ে “সহনশীল” ধর্ম, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মূল্যবোধের প্রতি সমর্থন ঠিক থাকে।”[৮২]
নায়েক সঙ্গীত ও বাদ্যযন্ত্রকে মদের সঙ্গে তুলনা করে বলেন যে দুটোই প্রকৃতিগতভাবে নেশা সৃষ্টিকারী। ইসলামে নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে তিনি নাচগানকে তিরস্কার করে থাকেন।[৩৪]
জাকির নায়েক বলেন যে, যে কোন দোষী ব্যক্তি শাস্তি পাবার যোগ্য। তিনি চুরির বিচার হিসেবে দুই হাত কেটে দেওয়ার নির্দেশনা দেন। যা কুরআনে চোরের শাস্তি হিসেবে উল্লেখ আছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রকেও তিনি এই আদেশ বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন যাতে সেই দেশে অপরাধের পরিমাণ কমে যায়।[৩৪]
নায়েক তার বক্তব্যে স্ত্রীকে হালকাভাবে প্রহার করার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তার বক্তব্য হল, “একটি পরিবার সামলানোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে, পুরুষই নেতৃস্থানীয় হবে। তাই, তার (নিজ স্ত্রীকে প্রহার করার) অধিকারটি আছে কিন্তু তার উচিত তার স্ত্রীকে হালকাভাবে প্রহার করা।[৩৪] নায়েক আরও বলেছেন যে[৮৩], মুসলিমদের নিজ দাসীদের সঙ্গে সহবাস করার অধিকার রয়েছে[৩১][৮৪], যেখানে তিনি “যুদ্ধবন্দী” হিসেবে দাসীদেরকে উল্লেখ করেন।[৮৫]
নায়েক সমকামীদের ব্যাপারে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। তিনি এলজিবিটি সম্প্রদায়কে “পাপে পূর্ণ মানসিক সমস্যায় ভোগা রোগী” হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বলেন যে “একমাত্র পর্নোগ্রাফিক চলচ্চিত্র দেখার কারণেই এটি ঘটে। এটা টিভি চ্যানেলগুলোর দোষ।”[৩৪] এছাড়াও “কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা অনুযায়ী”[৮৬], তিনি সমকামীদেরকে শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পরামর্শ দেন।[৮৬][৮৭]
নায়েক ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে[৩৪] বলেন যে, বিবর্তন বিষয়ক তত্ত্ব হল একটি প্রস্তাব মাত্র, এবং এটি খুব বেশি অপ্রমাণিত একটি অনুমান।”[৮৮] তার মতে, বেশিরভাগ বিজ্ঞানী এটা সমর্থন করেন এই কারণে যে, এটা বাইবেলের বিরুদ্ধে যায়, এই কারণে নয় যে এটা সত্য।”[৮৯] নায়েক দাবি করেন যে, কুরআন বহু বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ভবিষৎবাণী করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১০ সালে তিনি বলেন যে, কুরআনের কিছু নির্দিষ্ট আয়াতে মাতৃগর্ভে নবজাতক-ভ্রুনের বৃদ্ধি ও ক্রমবিকাশের ধাপগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করা হয়েছে।[৯০]
নায়েক দাবি করেন যে, “ডারউইন যা বলেছিলেন তা শুধু একটি তত্ত্ব মাত্র”। এমন কোন বই নেই যা ‘বিবর্তন বিষয়ক ফ্যাক্ট’ বলে – সকল বইই বলে বিবর্তন বিষয়ক তত্ত্ব। তিনি আরও বলেন, “পবিত্র কুরআনের এমন কোন কথা নেই, যা বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত মিথ্যা প্রমাণ করতে পেরেছে। প্রস্তাব কুরআনের বিরুদ্ধে যায় – তত্ত্বসমূহ কুরআনের বিরুদ্ধে যায়। কুরআনে বর্ণিত বৈজ্ঞানিক সত্যগুলোর মধ্যে এমন একটিও নেই, যা প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে গিয়েছে – সেটা হয়তো তত্ত্বের বিরুদ্ধে গিয়ে থাকতে পারে।”।[৩৪]
জাকির গণমাধ্যমকে “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার এবং বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ানক অস্ত্র” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন যা “সাদাকে কালো এবং খলনায়ককে নায়কে পরিণত করে”। তিনি পরামর্শ দেন যে, “এই একই গণমাধ্যমকে আমাদের ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা, ভুল উদ্ধৃতি, ভুল ব্যাখ্যা এবং ভুল প্রদর্শনগুলোকে মুছে দেয়ার জন্য ব্যবহার করা উচিত।”[৮২] তিনি দাবি করেন, পশ্চিমা ক্ষমতা এবং গণমাধ্যম একটি দ্বিমুখী-আদর্শের কৌশল অবলবম্বন করে, যারা ইসলামের সম্মানকে খাটো করার জন্য মুসলিমদেরকে চরমপন্থি এবং মৌলবাদী হিসেবে বর্ণনা করে।[৮২][৯১] তিনি বলেন, “আজকের দিনে ইসলামের ইমেজের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দ্বারা, যা দিনরাত একটি পরিকল্পিত কৌশলের মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কিত ভুল ধারণাগুলো গলা ফাটিয়ে প্রচার করছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, হোক তা প্রিন্ট, অডিও, ভিডিও, বা অনলাইন, তারা সকলেই একগুচ্ছ কৌশল অবলম্বন করে ইসলামের পরিচিতিকে খাটো করতে সর্বপ্রথম মুসলিম সম্প্রদায়ের কুলঙ্গারদেরকে তুলে আনে এবং এদেরকে এমনভাবে চিত্রায়িত করে যেন এরাই হল মুসলিমদের উদাহরণ।” নায়েক আরও দাবি করেন যে গণমাধ্যমের তৃতীয় ও চতুর্থ কৌশল হল, “কুরআন ও সুন্নাহ থেকে কোন কথা তুলে আনা এবং তা ভুলভাবে অনুবাদ করা” এবং “ইসলাম সম্পর্কে এমন কিছু বলে ইসলামের মর্যাদাকে খাটো করা যা আদৌ ইসলামের মধ্যে নেই”।[৮২]
নায়েক আরও বলেন, “কোন মুসলিম মহিলা যদি হিজাব বা বোরকা পড়ে তবে তারা এর ওপর নারীর পশ্চাৎপদতার লেবেল এঁটে দেয়, কিন্তু যদি কোন খ্রিস্টান পাদ্রী মহিলা একই কাজ করে তবে তা বদলে গিয়ে তাদের কাছে সম্মান ও শালীনতার প্রতীক হয়ে দাড়ায়। ৫০ বছরের বৃদ্ধ মুসলিম ১৬ বছরের মেয়েকে তার সম্মতিতে বিয়ে করলে তা হেডলাইনে ছাপা হয়, আর ৫০ বছরের অমুসলিম ৬ বছরের কোন মেয়েকে ধর্ষণ করলে তা সংক্ষিপ্ত সংবাদ বা ফিল্টারে ছাপা হয়। তারা বলে ইসলাম নারীকে অধিকার দেয় না, এবং এটি একটি অযৌক্তিক ধর্ম। তারা ইসলামকে মানবতার সমস্যা হিসেবে চিত্রায়িত করে যেন এটি শুধুই পুরুষদের সকল সমস্যার সমাধান দেয়। একই ঘটনা ঘটে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা শব্দ “মৌলবাদী” এবং “চরম্পন্থী”র ক্ষেত্রে, যেগুলো মূলত পশ্চিমা শব্দ।[৯১] একজন প্রকৃত মুসলিমকে অবশ্যই সঠিক দিকে চরমপন্থি হতে হবে, চরমভাবে দয়ালু, স্নেহপ্রবন, সহনশীল, সৎ এবং ভদ্র হওয়ার মাধ্যমে। যখন ভারতীয়রা তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল, ব্রিটিশ সরকার তাদেরকে সন্ত্রাসীর তকমা দিত; একই কাজ, একই ব্যক্তি, কিন্তু দুটি ভিন্ন তকমা। একই ঘটনা ঘটেছে মুসলিমদের সাথে যাদেরকে গণমাধ্যমে সন্ত্রাসীর তকমা দেয়া হয়েছে, তাই কাওকে কোন কাজের জন্য তকমা দেয়ার আগে আমাদের প্রসঙ্গ ও কারণের দিকে তাকানো উচিত।” [৮২]
তিনি চলচ্চিত্রে মুসলিমদের চিত্রায়িত করার সমালোচনা করে বলেন, “ইসলামের ইমেজকে হেয় করার জন্য হলিউডে এত শত শত চলচ্চিত্র বানানো হয়েছে যে, একজন মুসলিমকে “আল্লাহু আকবার” বলতে শুনলেই একজন অমুসলিম ভয় পেয়ে যায়, ভাবে যে সে হয়তো তাকে খুন করতে আসছে। যদি কেউ আসলেই ভালো ইসলামকে জানতে চায়, তাকে ইসলামের বিশুদ্ধ সূত্রকে পড়তে হবে; মহিমান্বিত কুরআন ও হাদিস বাদ দিয়ে এর অনুসারীদের (মুসলিমদের) দিকে তাকানো হল সেই গাড়িচালকের প্রসঙ্গের মত যার বেপরোয়া গাড়িচালনার কারণে দুর্ঘটনা ঘটলেও তার দ্বারা চালানো সর্বশেষ হালনাগাদকৃত মারসিটিজ গাড়িকেই ওই দুর্ঘটনার জন্য দোষ দেয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম হলেন সর্বশেষ ও চূড়ান্ত বার্তাবাহক নবী মুহাম্মাদ, তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।” এছাড়াও তিনি “সালমান রুশদির মত ইসলামের সমালোচনাকারী মুসলিমদের তুলে এনে তাদেরকে পদক দিয়ে পুরস্কৃত করার জন্য” গণমাধ্যমের সমালোচনা করেন এবং বলেন, “যদি কোন মুসলিম কোন মহৎ কাজ করে, তারা হয়তো তাকে তার কাজের কৃতিত্ব দেয় কিন্তু তার ধর্মকে এড়িয়ে যায় অথবা তার মুসলিম নামকে বদলে দেয়; যেমন প্রাচ্যের অ্যারিস্টটল “আভিসেনা” যার প্রকৃত নাম ছিল “আলী ইবনে সিনা“।”[৮২]
জাকির বলেছেন, কোন মুসলিম চাইলে ইসলাম থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারে, এবং এজন্য তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান নেই। কিন্তু কোন মুসলিম যদি ইসলাম ত্যাগের পর তার নতুন (অ-ইসলামিক) ধর্মবিশ্বাস প্রচার করে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলে, তবে সে বিশ্বাসঘাতক বলে বিবেচিত হবে। জাকির বলেন, ইসলামিক আইন অনুসারে[স্পষ্টকরণ প্রয়োজন] তার মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত, যেমনটি দেশদ্রোহীর শাস্তি হয়ে থাকে।[৯২][৯৩][৯৪] আরেকটি সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে নায়েকের বক্তব্য অনুযায়ী, “ইসলামে স্বধর্মত্যাগীদের জন্য মৃত্যুদণ্ডের কোন বিধান নেই, “যতক্ষণ না পর্যন্ত” উক্ত ধর্মত্যাগী ব্যক্তি ইসলামী শিক্ষার বিরুদ্ধে কোন মতবাদ প্রচার শুরু করে, যদি সে তা করে তবে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাবে।”[২২]
যদিও তিনি অন্যান্য ধর্মের মানুষদের উৎসাহিত করে থাকেন যেন তারা তাদের দেশে মুসলিমদেরকে স্বাধীনভাবে ধর্মপ্রচারের সুযোগ দেয়, নায়েক বলেন যে, একটি ইসলামী রাষ্ট্রে অন্যান্য ধর্মের ধর্মপ্রচার অবশ্যই নিষিদ্ধ করা উচিত কারণ (তিনি বিশ্বাস করেন) অন্যান্য ধর্মগুলো ভুল, তাই তাদের প্রচারণাও ভুল, এটা এরকম যে কোন অংকের শিক্ষক কাওকে ২+২=৪ এর পরিবর্তে ২+২=৩ শেখাচ্ছেন। একইভাবে, নায়েক বলেন যে, “গির্জা বা মন্দিরের ভবন নির্মাণের ব্যপারে, কিভাবে আমরা তার অনুমতি দিতে পারি যখন কিনা তাদের ধর্মটাই ভুল এবং তাদের উপাসনাটিও ভুল?”[৯৫]
মুসলিম বিশ্বে খ্রিস্টান মিশনারিগুলোর ধর্মপ্রচার কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে নায়েক বলেন যে, “মিশনারিগুলো মুসলিমদের দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার জন্য বাইবেলের বানীগুলো আরবি ক্যালিগ্রাফিতে লেখে, যেমন “ঈশ্বর হলেন প্রেম।” আমরা পিস টিভিতে উদাহরণস্বরূপ এমন প্রতারণার কৌশল ব্যবহার করি না।[৮২]
গাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া এক বক্তৃতায়[৬৭][৬৮][৯১], জাকির বিশ্বজুড়ে জিহাদের নামে বর্বর কর্মকাণ্ডের কঠোর সমালোচনা করেন, যেখানে নিরপরাধ মানুষ মারা যায় এবং বলেন যে, “মুসলিমগণ ও অমুসলিমগণ উভয়ই জিহাদকে ভুলভাবে বুঝে থাকে, জিহাদ অর্থ সমাজকে আরও ভালো করার জন্য চেষ্টা ও সংগ্রাম করা। জিহাদের সবচেয়ে ভালো রূপ হল কুরআনের শিক্ষা ব্যবহার করে অমুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা; নবী ও মহান আল্লাহর কাছে, ইসলাম অর্থ হল শান্তি।”[৯১] তিনি আরও বলেন, “কোন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা, হোক সে মুসলিম বা অমুসলিম, তা ইসলামে নিষিদ্ধ। কিন্তু পশ্চিমা ক্ষমতা ও তাদের গণমাধ্যম একটি পরস্পরবিরোধী আদর্শিক ভূমিকা পালন করে, যারা মুসলিমদের চরমপন্থি ও মৌলবাদী হিসেবে বর্ণনা করে। এমনকি ইসলামী জিহাদেও, কখন ও কিভাবে একজন মানুষকে হত্যা করতে হবে তার বাধাধরা নিয়ম দেয়া আছে, যা বিশ্বজুড়ে বর্তমানে জিহাদের জন্য লড়াই করে এমন দাবি করা কিছু দলের কাজকর্মের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।”[৯১]
দুবাইয়ের আল-খানাবিজে দেওয়া আরেকটি বক্তৃতায় তিনি বলেন,, “ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের দ্বারা এমনকি মুসলিমদের দ্বারাও সবচেয়ে ভুলভাবে অনুদিত ও সবচেয়ে ভুলভাবে বোঝা শব্দ হল ‘জিহাদ’, যার সাথে ‘পবিত্র যুদ্ধের’ কোন সম্পর্ক নেই, এবং এই শব্দটি কুরআন ও সুন্নাহর কোথাও ব্যবহৃত হয় নি, এটা প্রথম ব্যবহৃত হয় ক্রুসেডারদের দ্বারা যারা খ্রিস্টধর্মের নামে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষ হত্যা করেছিল। জিহাদ শব্দের প্রকৃত অর্থ হল চেষ্টা ও সংগ্রাম করা: কারো নিজস্ব কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে, সমাজকে আরও ভালো করে গড়ে তুলতে, যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের আত্মরক্ষা করতে এবং নির্যাতন-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে।”[৮২]
একটি ইউটিউব ভিডিওতে ওসামা বিন লাদেন সম্পকে জাকির বলেন যে, তিনি বিন লাদেনকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনেনও না, তাদের কখনও সাক্ষাৎ হয়নি। যদি বিবিসি, সিএনএন দেখে যদি লাদেন সম্পর্কে বলতে হয়, তাহলে তাকে বলতেই হবে যে লাদেন একজন সন্ত্রাসী। কিন্তু কুরআন বলছে যে কোনো সংবাদ পেলে তা প্রচারের আগে যাচাই করে নিতে। তাই, তিনি তাকে দোষারোপ করতে পারেন না। তিনি আরো বলেন, যদি বিন লাদেন সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী আমেরিকাকে ভয় দেখিয়ে থাকে, তবে আমিও তার সাথে আছি। বিষয়টা হল, সে যদি কোন সন্ত্রাসীকে সন্ত্রস্ত করে, তবে সে মূলত ইসলামেরই অনুসরণ করছে।”[১৯][৩৩][৩৪]
৩১ জুলাই ২০০৮ সালে পিস টিভিতে দেওয়া লেকচারে জাকির নাইন ইলেভেন সম্বন্ধে মন্তব্য করেন, ‘এটি একটি সাজানো নাটক, একটা ওপেন সিক্রেট যে টুইন টাওয়ারে হামলা সম্পূর্ণই প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের কাজ।’[১১][২২][৩১] এই কথার প্রমাণ হিসেবে তিনি কিছু রিসার্চের উদ্ধৃতি দেন।[৯৬][৯৭] কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ৯/১১ সম্পর্কিত তার এই বক্তব্যকে অস্বীকার করে[৯৮] এবং এ ধরনের বিভিন্ন বক্তব্যে জড়িত থাকার কারণে যুক্তরাজ্য ও কানাডায় তার প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।[৬১][৬২]
জাকিরের মতে ইসলামী সন্ত্রাসবাদ মিডিয়ার (প্রচারমাধ্যমের) সৃষ্টি।[৯৯] তিনি বলেন, মুসলমানদের এমন হওয়া উচিত যেন তাদেরকে দেখলে সমাজবিরোধী লোকদের মাঝে ত্রাসের সৃষ্টি হয় এবং এরূপ হলে প্রত্যেক মুসলমানকে একজন সন্ত্রাসী হওয়া দরকার ।[১০০] টাইম পত্রিকা এই উক্তিকে “নিজবুল্লাহ জাহির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা” বলে ইঙ্গিত করলে জাকির বলেন, “আমি সবসময়ই সন্ত্রাসবাদকে দোষারোপ করি, কারণ মহিমান্বিত কোরআন অনুসারে, কেউ যদি একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করো তবে সে যেনো পুরো মানবজাতিকে হত্যা করলো।”[৩৪][১০০][১০১][১০১] তিনি হিটলারকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “সে মুসলিম না হয়েও বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী কারণ সে প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছিল।”[৮২]
নায়েককে হত্যা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “কুরআন বলে – কেউ যদি নিরপরাধ একটি মানুষকে হত্যা করে, হোক সে মুসলিম বা অমুসলিম, এটা এমন যে সে পুরো মানবতাকে হত্যা করলো। অতএব কিভাবে একজন মুসলিম কোন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে পারে?”।[১০২] তবে, তিনি বলেন কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা বৈধ হবে “যদি সে কাওকে হত্যা করে…অথবা কোন স্থানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।”[১৯] এছাড়াও তিনি “কুরআন বা হাদিসের বানি তুলে নিয়ে ইসলামকে সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড সমর্থনকারী ধর্ম হিসেবে ভুলভাবে তুলে ধরতে সেই বানীগুলোকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে উদ্ধৃত করার জন্য” মিডিয়ার সমালোচনা করেন।[৮২] তিনি আরও দাবি করেন, “ইসলামের সমালোচকগণ (কুরআনের) ৫/৯ নং আয়াতটিকে ইসলামকে হেয় করার জন্য অপ্রাসঙ্গিকভাবে উদ্ধৃত করে যাতে বলা হয়েছেঃ “যেখানেই একজন অমুসলিমকে খুঁজে পাও, তাকে হত্যা করো।” যদিও এটি ছিল যুদ্ধের ময়দানে একটি নির্দেশ, এবং ইসলাম সর্বদা যুদ্ধের সময় তুলনামূলক উত্তম সিদ্ধান্ত হিসেবে শান্তিকে সমর্থন করে।”[৮২]
স্কাইপের মাধ্যমে একটি প্রেস কনফারেন্সে, জাকির নায়েককে আত্মঘাতী বোমাহামলা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন যে, ইসলামে এর অনুমতি আছে, এবং আরও বলেন “নিরপরাধ মানুষকে যদি হত্যা করা হয় তবে এটি হারাম। কিন্তু আত্মঘাতী বোমাহামলা যদি যুদ্ধকৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয় তবে এটি বৈধ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, জাপান যুদ্ধকৌশল হিসেবে আত্মঘাতী বোমাহামলাকে ব্যবহার করেছিল।”[৮১][১০৩][১০৪]
২০১৬-র জুলাইয়ে এক ভিডিও বার্তায়, নায়েক ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়াকে “অ্যান্টি-ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া” বলে সম্বোধন করেন এবং বলেন যে, ইসলামের শত্রুরা আইসিসের প্রচার করছে। তিনি আরও বলেন যে, “কুরআন বলে – কেউ যদি নিরপরাধ একটি মানুষকে হত্যা করে, হোক সে মুসলিম বা অমুসলিম, এটা এমন যে সে পুরো মানবতাকে হত্যা করলো। অতএব কিভাবে একজন মুসলিম কোন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে পারে? .. আমাদের ISIS বলা উচিত না, আমাদের বলা উচিত AISIS। কারণ এটা অ্যান্টি-ইসলামিক বা ইসলাম বিরোধী। আমি বিশ্বের সকল মুসলিমদের এবং মুসলিম গণমাধ্যমগুলোকে অনুরোধ করছি যে, দয়া করে ইসলামের শত্রুদেরকে ইসলামকে আক্রমণের ব্যাপারে সাহায্য করবেন না।” তিনি আরও বলেন যে, “আপনি যদি ভালো করে খতিয়ে দেখেন তাহলে আপনি জানতে পারবেন যে আমি পুরোপুরি সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে। আমি নিরপরাধ মানুষ হত্যার পুরোপুরি বিপক্ষে।”[১০২] যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্তৃক সিরিয়া ও ইরাকে আইসিসের উপর আক্রমণের পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে জাকির বলেন যে, তিনি অবশ্যই ইসলামিক স্টেট গ্রুপের কাজকর্মকে কঠোরভাবে নিন্দা করেন, কিন্তু একই সাথে তিনি আমেরিকার দ্বারা সেখানে আক্রমণের পদক্ষেপকেও অসমর্থন করেন।[৯১]
জাকির অরল্যান্ডো বন্দুকহামলার সঙ্গে “ইসলামের জুড়ে দেয়ার” জন্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সমালোচনা করেন। তিনি উক্ত ঘটনার হামলাকারীকে “দ্বিমুখীভাবে” প্রচার করার জন্য গণমাধ্যমকে দোষারোপ করে বলেন যে, “একই (দ্বিমুখী-আদর্শিক কৌশল) ঘটনা ঘটেছে সে লোকটির সাথে যার ইসলামের সঙ্গে কোনভাবেই কোন সম্পর্ক নেই কিন্তু তার নামের সঙ্গে রয়েছে, যে অরল্যান্ডোতে ৫০ জন সমকামীকে হত্যা করেছে। সংবাদটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, এবং মুসলিম সম্প্রদায় এই ঘটনার কারণে হয়রানির শিকার হয়, যদিও খুনি নিজেই একজন সমকামী ছিল এবং সে সমকামী ক্লাবে প্রায়শই মারপিট করতো। হামলাকারী ব্যক্তি কখনোই ইসলাম পালন করত না, কিন্তু তবুও তার ধর্মপরিচয়কেই সবার আগে তুলে ধরা হল, আর একই কাজ যদি কোন অমুসলিম করতো, তাহলে গণমাধ্যম বেছে বেছে বলতো যে, এক উন্মাদ ৫০ সমকামীকে হত্যা করেছে।”[৮২]
২০১৯ সালের ১১ই মে ভারতের দ্য উইক সাময়িকীর একটি সাক্ষাৎকারে নায়েক নরেন্দ্র মোদি ও তার দল বিজেপির সমালোচনা করে বলেন, এরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এবং তার জনপ্রিয়তার কারণে তাকে লক্ষবস্তু বানানো হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মোদি ক্ষমতায় থাকলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি দেশে ফিরবেন না, যেমনটা হিজরতের সময় নবী মুহাম্মদ করেছিলেন। [১০৫] তিনি মোদিকে “মিথ্যাবাদী” ও “গুগল অনুসারে ভারতের একনম্বর সন্ত্রাসী” হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, মোদি ভারতীয় মুসলিমদের জন্য বিপজ্জনক। [১০৬] ইতোপূর্বে, ২০১৬ সালের জুলাইতে নায়েক মোদির প্রশংসা করে বলেন, “আমি পুরোপুরি তার সমর্থক” কারণ তিনি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি সবচেয়ে বেশি মুসলিম দেশ সফর করেছেন।[১০৭]
দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ‘‘সবচাইতে শক্তিশালী ১০০ ভারতীয় ২০১০’’ তালিকায় জাকিরের অবস্থান ৮৯তম। ২০০৯ সালে তার অবস্থান ছিলো ৮২তম। প্রাভেন স্বামীতে জাকিরকে বলা হয়, ভারতে সবচাইতে বেশি প্রভাবশালী সালাফি ব্যাখ্যাকারী। সঞ্জিভ ভুট্টোর মতে, তিনি ইসলামের একজন কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃত, কিন্তু তিনি অন্য ধর্মের ওপর নেতিবাচক মন্তব্যকারী হিসেবে খ্যাত। সদানন্দ ধুমি লিখেছেন যে,
“জাকির নায়েক মধ্যপন্থী ইমেজ সৃষ্টি করতে পেরেছেন কারণ তার মৃদু আচরণ, স্যুট এবং টাই পরা এবং অন্যান্য ধর্মের ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া।”
(“carefully crafted image of moderation”, because of his gentle demeanor, his wearing of a suit and tie, and his quoting of scriptures of other religions”)[১০৮]
নায়েককে ২০০৯[১০৯],২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালের[১১০] ৫০০ সবচাইতে প্রভাবশালী মুসলিমদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এছাড়াও ১৭ দুবাই আন্তর্জাতিক পবিত্র কুরআন পুরস্কার জাকির নায়েককে বছরের ইসলামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে নামকরণ করে।[১১১][১১২]
পুরস্কার বা সম্মাননার সাল | পুরস্কার বা সম্মাননার নাম | পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থা বা সরকার |
---|---|---|
২০১৩ | ইসলামিক পারসোনালিটি অব ২০১৩[১১৩] | শাইখ মোহাম্মাদ রাশিদ আল মাখতুম এ্যাওয়ার্ড ফর ওয়ার্ল্ড পিস |
২০১৩ | ডিস্টিংগুইশড ইন্টারন্যাশনাল পারসোনালিটি এওয়ার্ড[১১৪] | আজম, টুয়ানকু আব্দুল হালিম মুয়াদজাম শাহ, মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান |
২০১৩ | শারজাহ এওয়ার্ড ফর ভলান্টারি ওয়ার্ক | সুলতান বিন মোহাম্মেদ আল কাশিমি, শারজাহর শাসক |
২০১৪ | ইন্সাইনিয়া অব দ্য কমান্ডার অব দ্য ন্যাশনাল অর্ডার অব দ্য রিপাবলিক অব দ্য গাম্বিয়া[১১৫] | গাম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া জাম্মেহ |
২০১৪ | অনারারি ডক্টরেট (ডক্টর অব হিউম্যান লেটারস)[১১৫] | গাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় |
২০১৫ | বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার[১১৬] | সৌদি আরব |
মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয় হলেও জাকির নায়েক তার বক্তব্য ও মতের জন্য বিভিন্ন স্থানে সমালোচিত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিন লাদেন যদি যুক্তরাষ্ট্রের মত সন্ত্রাসী রাষ্ট্রকে সন্ত্রাসের মাধ্যমে হুমকির সম্মুখীন করে তাহলে তিনি বিন লাদেনের পক্ষে’; ‘ইসলামের শত্রু বা যুক্তরাষ্ট্রকে কোন উপায়ে হুমকির সম্মুখীন করাকে সন্ত্রাস’ বলা হলে তিনি ‘প্রত্যেক মুসলিমেরই সন্ত্রাসী হওয়া উচিত’ বলে মন্তব্য করেন। আফগান বংশোদ্ভূত সন্ত্রাসী নাজিবুল্লাহ জাজি জাকির নায়েকের বক্তৃতা শুনে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন।[১১৭] তিনি শিয়া ও সুন্নিদের বিরোধ বিষয়ে কথা বলেন এবং খলিফা ইয়াজিদের নামের পর রাদিয়াল্লাহ তা’আলা (আল্লাহ্ তাদের অনুগ্রহ করুন) বলেন, এতে বহু মুসলমান দ্বারা তিনি ঘৃণিত হন; বিশেষ করে শিয়াদের দ্বারা। তিনি আরও বলেন, কারাবালার যুদ্ধ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত;[১১৮] উক্ত মন্তব্যটিও যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছিল।[১১৯]
ভারতীয় সাংবাদিক খুশবন্ত সিং বলেন, জাকির ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করেন। সিং বলেন, নায়েকের বিবৃতি ‘‘শিশুতোষ’’ । তিনি আরও বলেন, তা আন্ডারগ্রাজুয়েট কলেজের বিতর্কের কদাচিৎ উপড়ে ওঠে; যেখানে প্রতিযোগীরা ক্ষুদ্র স্কোরের জন্য লড়ে। তিনি আরও বলেন, তার কথা মগ্ন হয়ে শুনুন, তিনি প্রায়ই বিপুল উৎসাহে বিস্ফোরিত হন, যখন তিনি অন্যান্য ধর্মের বাণীকে খাটো করেন।[১২০]
টরেল ব্রেক নামক নরওয়ের একজন ধর্মীয় ইতিহাস অধ্যাপক নায়েককে অন্যান্য ধর্ম ও ইসলামের অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপর তার মৌখিক আক্রমণের জন্য “অতি সমালোচিত ব্যক্তিত্ব” বলে উল্লেখ করেন। তিনি লেখেন যে, ভারতীয় ওলামাদের অনেক সদস্য নায়েককে কঠিনভাবে অপছন্দ করেন কারণ নায়েক তাদের দেয়া ব্যাখ্যাকে এড়িয়ে যায় এবং সে বলে যে, যে কেউ কুরআনের ব্যাখ্যা করতে পারে।[১২১] রক্ষণশীল দেওবন্দি আলেমগণ নায়েককে “মুসলিমদের সঠিক ইসলামের ব্যাখ্যা থেকে দুরে সরিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইসলাম ধ্বংসের” দায়ে অভিযুক্ত করে থাকেন। [১২২]
ওসামা বিন লাদেনকে ‘‘ইসলামের সৈন্য’’ বলায় আলী সিনা এবং খালিদ আহমেদ নায়েকের সমালোচনা করেন। তারা বলেন যে, জাকির আল-কায়দাকে পরোক্ষ ভাবে সমর্থন করছেন।[১২৩] ২০০৮ সালে লখনউ-এর ইসলামি পণ্ডিত সাহার কাজী মুফতি আব্দুল ইরফান মিয়া ফিরিঙ্গি মাহালি জাকিরের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেন যে তিনি ওসামা বিন লাদেনকে সমর্থন করেন এবং তার পদ্ধতি অ-ইসলামিক। ফেব্রুয়ারি ২০১১তে, তিনি ভিডিও লিংকের মাধ্যমে ‘অক্সফোর্ড ইউনিয়ন’কে পত্র লেখেন।[১২৪]
ভারতীয় সাংবাদিক শোয়াইব দানিয়াল জাকিরের “মার্কিনিরা স্বেচ্ছায় নিজেদের মধ্যে স্ত্রী বিনিময় করে কারণ তারা শুকর খায়, যা নিজেও স্বয়ং স্ত্রী বিনিময় করে” বক্তব্যটির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি আরও তুলে ধরেন যে, “ইসলাম পুরুষকে একাধিক নারীকে বিয়ের অনুমতি দেয় কারণ “যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি” ” জাকিরের এই বক্তব্যটি যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।[২২]
২০১২ সালে ভারতীয় সরকার জাকিরের পিস টিভির সম্প্রচার নিষিদ্ধ করে;[১২৫][১২৬] নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা অজ্ঞাতনামা এক ভারতীয় সাংবাদিকের মন্তব্য উল্লেখ করে বলে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুম্বাই পুলিশ তার আলোচনা-সভার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কারণ “তিনি সমালোচনার জন্ম দেন” এবং ভারতীয় স্যাটেলাইট সরবরাহকগণ তার টেলিভিশন চ্যানেল “পিস টিভি”র সম্প্রচারে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।[২৬]
২০১৬ সালে ঢাকায় সন্ত্রাসী আক্রমণের ৫ হামলাকারীর মাঝে একজন ফেসবুকে জাকির নায়েকের অনুসারী ছিলেন বলে বাংলাদেশী পত্রিকা ডেইলি স্টারে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর, ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিরেন রিজিজু বলেন, “জাকির নায়েকের বক্তব্য আমাদের জন্য একটি নজরদারির বিষয়। আমাদের এজেন্সিগুলো এর উপর কাজ করছে।”[১২৭] এর ২ দিন পর মহারাষ্ট্র সরকারের সিআইডি বিভাগ তদন্তের ফলাফল হিসেবে জানায় যে, তারা জাকির নায়েকের বক্তৃতায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার কোন প্রমাণ খুজে পায় নি।[১২৮] ডেইলি স্টার উক্ত বিতর্ক নিয়ে জাকির নায়েকের নিকট ক্ষমা চেয়ে মন্তব্য করে যে তারা কখনোই নায়েককে উক্ত হামলার জন্য দোষারোপ করে নি।[৩২] পত্রিকাটি বলে যে, এটি শুধুমাত্র এটাই তুলে ধরেছে যে, কিভাবে তরুণরা তার বক্তব্যকে ভুলভাবে বুঝছে।[৩২][১২৯][১৩০] তবে, এঘটনার পরপরই বাংলাদেশ সরকার নায়েকের পিস টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়।[১৩১] তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এর কারণ হিসেবে বলেন যে “পিস টিভি মুসলিম সমাজ, কুরআন, সুন্নাহ, হাদিস, বাংলাদেশের সংবিধান, আমাদের সংস্কৃতি, আচার-প্রথা ও রীতিনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।”[২৮]
বাংলাদেশী লেখিকা তসলিমা নাসরিন নায়েককে “বিপজ্জনক” হিসেবে বর্ণনা করেন কারণ “সে একুশ শতাব্দীতে এসে ৭শ শতাব্দীর যৌন দাসী, বহুবিবাহ এবং স্ত্রী প্রহার সম্পর্কিত কুরআনিক বানীর সমর্থন ও প্রচার করে।” তিনি তার ধারাবাহিক টুইটে বলেন, “আমি জাকিরের বক্তব্য শুনেছি। সে কুরআনের উদ্ধৃতি তুলে ধরে এবং তা সঠিক প্রমাণের চেষ্টা করে। সে বিপজ্জনক, কারণ ২১ শতাব্দীতে এসে ৭ম শতাব্দীর বানী প্রচার করা বিপজ্জনক।” বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের দ্বারা ঘাতক হামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, “বহু বাংলাদেশী উঠতি সন্ত্রাসী তার দ্বারা উদ্বুদ্ধ। তাকে হাতেনাতে ধরা যাচ্ছে না। কিন্তু তার অনুসারীরা হাতেনাতে ধরা পরছে।”। তিনি আরও বলেন, “আমি জাকির নায়েকের বাক স্বাধীনতার বিরোধী না কিন্তু সহিংসতাকে উস্কে দেয়ার জন্য আমি তার বিপক্ষে। ফতোয়াবাজকে ফতওয়া প্রদান করা থেকে নিষিদ্ধ করা উচিত।”[১৩২]
২০১৬ এর জুলাইয়ে ভারতীয় পত্রিকা ফার্স্টপোস্টের সাংবাদিক শ্রীময় তালুকদার তার এক প্রতিবেদনে জাকির নায়েকের সমালোচনা করে বলেন, সে ইসলামের এমন এক সংস্করণের প্রচার করে “যা প্রাণহীন এবং আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।”[১৩৩][১৩৪]
২০০৭ সালের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয় যে, দারুল উলুম জাকিরকে একজন নিজস্ব-শৈলীর ধর্মপ্রচারক বলে মনে করে যিনি ইসলামের প্রথাগত চারটি মাজহাব (ফিকহ) হতে বিচ্ছিন্ন এবং একারণে তারা তাকে “গায়রে মুকাল্লিদিন[১৩৫] হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে এবং মুসলিমদেরকে তার বক্তৃতা না শোনার আহ্বান জানায়।[১৩৬][১৩৭] ২০১৬ সালে দারুল উলুমের এক প্রতিনিধি বলেন, নৈতিক ইস্যুতে যদিও দারুল উলম জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে কিছু ফতওয়া জারি করেছে, কিন্তু গণমাধ্যম সেগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচার করছে।[১৩৮] দারুল উলুমের সহ সভাপতি আব্দুল খালিক মাদ্রাসি জাকিরের সমর্থনে বলেন: “জাকির নায়েকের সাথে আমাদের অনেক মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সে একজন ইসলামী পণ্ডিত হিসেবে স্বীকৃত। আমরা কোনভাবেই বিশ্বাস করি না যে সে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।” [১৩৯]
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৯-এর মে মাসে এক নির্বাচনী প্রচারনায় জাকির নায়েকের নিন্দা জানিয়ে বলেন, এই নায়েকের কথায় উৎসাহিত হয়ে শ্রীলংকায় বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা সত্ত্বেও কংগ্রেস পার্টি নায়েককে সমর্থন করে।[১৪০][১৪১]
২০১৬-র ১৩ই জুলাই, বিষ্ণু হিন্দু পরিষদের নেত্রী সাধ্বী প্রাচী ঘোষণা করেন যে, কেউ যদি জাকির নায়েকের শিরশ্ছেদ করে আনতে পারে তবে তাকে ৫০ লক্ষ রুপি পুরস্কার দেওয়া হবে।[১৪২] ”’হুসনি টাইগার”’ নামক স্বঘোষিত শিয়া দল কর্তৃক জাকির নায়েকের মাথার বিনিময়ে ১৫ লাখ রুপি পুরস্কার ঘোষণা করার একদিন পরে এই ঘটনা ঘটে।[১৪৩]
সমকামী এবং ধর্ম ত্যাগকারীদের মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়ার পক্ষপাতি হওয়ায় ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে সাদানন্দ দুমে সমালোচনা করেন।[১৪৪] তিনি জাকির নায়েকের বক্তব্য; ভারত শরিয়া আইন দ্বারা শাসিত হওয়া উচিত এই জাতীয় মন্তব্যেরও সমালোচনা করেন। জাকির নায়েকের মতে “ইহুদীরা আমেরিকা শাসন করছে” এবং তারাই মুসলিম দুনিয়া প্রধান শত্রু, জাকিরের এই দৃষ্টিভঙ্গির তিনি সমালোচনা করেন। মুসলিম ভূমিতে অমুসলিমের কোন উপাসনালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা এবং তালিবানের বামিয়ান বৌদ্ধদের উপর বোমা হামলার প্রতি নায়েকের সমর্থনকে তিনি আলোচনায় তুলে ধরেন। দুমেনের মতে মানুষ নায়েকের বার্তাকে গুরুতর ভাবে নিচ্ছে যার প্রমাণ দেখা গিয়েছিল নাজিবুল্লাহ জাজি, রাহিল শেখ এবং কাফেল আহমেদের মত মানুষদের ক্ষেত্রে যারা প্রকৃতপক্ষে ছিল জাকির নায়েকের অনুসারী। নাজিবুল্লাহ জাজি গ্রেফতার হন নিউইয়র্ক সাবওয়েতে নিজের উপর বোমা মেরে আতঙ্ক সৃষ্টির পরিকল্পনা করার জন্য। ২০০৬ সালে মুম্বাইতে সিরিজ বোমা হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিল রাহিল শেখ এবং কাফেল আহমেদ আত্মহন্তারক হিসেবে গ্লাসগো এয়ারপোর্টে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে গিয়ে ব্যর্থ হন। দুমে আরো বলেন, “ভারতীয়রা যেভাবে হিন্দুমৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার, একইভাবে যদি এই কট্টোর ইসলামপ্রচারকারীর বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে না পারে, তবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত বিনির্মাণের যে আদর্শ তাতে গভীর ক্ষত রয়ে যাবে।”[৮৭]
নির্বাসিত বাংলাদেশী লেখিকা তসলিমা নাসরিন নায়েককে আধুনিক সমাজের জন্য ‘ভয়ঙ্কর’ একজন ব্যক্তি বলে মন্তব্য করেন। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন, “জাকির নায়েক সপ্তম খ্রিষ্টাব্দে ব্যবহৃত কোরানের আয়াতকে ন্যায্যতা দেওয়ার প্রচেষ্টা করছেন। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও যৌনদাসী, বহুবিবাহ এবং স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার মত কাজগুলিকে সমর্থন জানাচ্ছেন। নায়েক খুব ভয়ঙ্কর, কারণ তিনি একবিংশ শতকেও সপ্তম শতকের নিয়ম চালু রাখার চেষ্টা করেন।“[১৪৫][১৪৬]
২০১৯ সালের ৮ আগস্ট মালেয়শিয়ার কেলেন্টান রাজ্যের কোটা ভারুতে এক বক্তৃতা চলাকালীন সময়ে জাকির নায়েক বলেন মালয়েশিয়ার হিন্দুরা ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের চেয়েও একশো গুন বেশি অধিকার ভোগ করে এবং তারা মালেয়শিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি বেশি অনুগত। তার এই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনার পর তিনি প্রতিক্রিয়ায় আরো বলেন মালেয়শিয়ায় বসবাসকারী চীনারা এখানকার অতিথি, তাদের মালেয়শিয়ায় ফিরে যাওয়া উচিত। তিনি আরো বলেন তাকে মালয়েশিয়া থেকে বের করে দেয়ার আগে সেখান থেকে চীনাদের বের করে দেয়া প্রয়োজন। [১৪৭]
তার এ বক্তব্যের পরে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে বসবাসকারী হিন্দু ও চীনা সম্প্রদায়ের বিষয়ে উসকানিমূলক মন্তব্য করে শান্তি বিঘ্নিত করার অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। ১৫ আগস্ট বিভিন্ন রাজনীতিবিদসহ চারজন মন্ত্রী জাকির নায়েককে মালেয়শিয়া থেকে বহিস্কার এবং ভারতে প্রত্যার্পণের অনুরোধ জানায়।[১৪৮][১৪৯] জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে সর্বমোট ১১৫ টি অভিযোগ মালেয়শিয়ার পুলিশের কাছে দাখিল হয়।[১৫০]
১৬ আগস্ট তার বিতর্কিত মন্তব্যের দরুণ তাকে রয়াল মালেয়শিয়া পুলিশ জেরা করে। তাকে পুলিশ সাতঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে।[১৫১] ১৫ আগস্ট মালেয়শিয়ার বৃহত্তম রাজ্য শারাওয়াক প্রদেশে জাকির নায়েকের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়।[১৫২] এরপর ১৬ আগস্ট পার্লিশ তার জনসম্মুখে ভাষণ দেওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়।[১৫৩] এরপর ১৭ আগস্ট কেদায়,[১৫৪] ২০ আগস্ট সাবায়, মালাক্কায়, পিনাঙ্গে এবং সিনাগরে জনসম্মুখে তার ভাষণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়৷ পরবর্তীতে ২০ আগস্ট ফ্রি মালেয়শিয়া টুডে প্রতিবেদন অনুসারে পুলিশ সমগ্র দেশেই তার জনসম্মুখে ভাষণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে।[১৫৫] প্রশাসন এবিষয়টি মালয় মেইলকে নিশ্চিত করে।[১৫৬] পরবর্তীতে প্রশাসন থেকে জানানো হয়, যতক্ষণ না তদন্ত শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ অবধি জাকির নায়েক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কোনো বক্তব্য রাখতে পারবেন না।[১৫৭]
১৯ আগস্ট জাকির নায়েক তার আইনজীবির মাধ্যমে মালেয়শিয়ার ৫ জন রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন।[১৫০] পরের দিন তিনি তার বক্তব্যের জন্য সবার কাছে ক্ষমা চান।[১৫৫]
ডঃ জাকির নায়েক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন। তার বক্তৃতায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আমন্ত্রিত ও অনামন্ত্রিত শ্রোতাগণ অংশগ্রহণ করেন। তার উল্লেখযোগ্য বক্তৃতা পরবর্তীতে মূল ইংরেজিসহ একাধিক ভাষায় বই হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৭ সালে দার- উস- সালাম প্রকাশনী (সৌদি আরব) জাকির নায়েকের দুইটি বই প্রকাশ করে। যথাঃ ‘দি কনসেপ্ট অফ গড ইন মেজর রেলিজিওনস’ (জনপ্রিয় ধর্ম গুলোতে ঈশ্বরের ধারণা)এবং ‘দি কুরআন অ্যান্ড মর্ডান সায়েন্সঃ কম্পিটেবল অর ইনকম্পিটেবল’ (কুরআন এবং আধুনিক বিজ্ঞানঃ সাদৃশ্যপূর্ণ নাকি বৈসাদৃশ্যপূর্ণ) । বাংলাদেশে একাধিক প্রকাশনী তার বইসমূহ বাংলায় অনূবাদ করে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছে[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]।
|
|
|