আসাদুল্লাহ আল-গালিব
এম.এ. (অধ্যয়নরত), ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
ভূমিকা :
মহান আল্লাহ বান্দার প্রতি অতি দয়াবান। তিনি সর্বদা বান্দার জন্য সহজ চান, কঠিন চান না। তিনি কারও উপর যুলুমকারী নন। সর্বদা বান্দার কল্যাণ চান। তিনি চান বান্দার সমস্ত পাপ ক্ষমা করে তাকে দ্বীনের সঠিক পথে পরিচালিত করতে। মহান আল্লাহ বলেন, يُرِيدُ اللهُ لِيُبَيِّنَ لَكُمْ وَيَهْدِيَكُمْ سُنَنَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَيَتُوبَ عَلَيْكُمْ وَاللهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ، ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য (হালাল-হারাম) ব্যাখ্যা করে দিতে চান ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের (সুন্দর) রীতি সমূহের প্রতি তোমাদের পথ প্রদর্শন করতে চান এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করতে চান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (নিসা ৪/২৬)। আল্লাহ যাদের কল্যাণ চান নিম্নে তাদের সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরা হ’ল।
(১) ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন :
আল্লাহ যার কল্যাণ চান তার অন্তরকে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করেন। মহান আল্লাহ বলেন,فَمَنْ يُرِدِ اللهُ أَنْ يَهْدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ وَمَنْ يُرِدْ أَنْ يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا، ‘অতএব আল্লাহ যাকে সুপথ প্রদর্শন করতে চান, তিনি তার বক্ষকে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। আর যাকে পথভ্রষ্ট করতে চান, তার বক্ষকে সংকীর্ণ ও সংকুচিত করে দেন’ (আন‘আম ৬/১২৫)।
অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন, أَفَمَن شَرَحَ الله ُصَدْرَهُ لِلإسْلامِ فَهُوَ عَلَى نُورٍ مِّن رَّبِّهِ، ‘যার বক্ষকে আল্লাহ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন, অতঃপর সে তার প্রতিপালকের দেওয়া জ্যোতির মধ্যে রয়েছে’ (যুমার ৩৯/২২)।
(২) তওবার সুযোগ দেন :
আল্লাহ যার কল্যাণ চান সে ব্যক্তি তওবার সুযোগ পায়। মহান আল্লাহ বলেন, وَاللهُ يُرِيدُ أَنْ يَتُوبَ عَلَيْكُمْ ‘আর আল্লাহ চান তোমাদের তওবা কবুল করতে’ (নিসা ৪/২৭)।
(৩) বিপদাপদের সম্মুখীন করেন :
বিপদাপদ মহান প্রভুর পক্ষ থেকে এক বড় নে‘মত। তিনি এর মাধ্যমে বান্দাকে পরীক্ষা করে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَيْءٍ مِّنَ الْخَوفْ وَالْجُوعِ وَنَقْصٍ مِّنَ الأَمَوَالِ وَالأنفُسِ وَالثَّمَرَاتِ ‘আর অবশ্যই আমরা তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, ধন ও প্রাণের ক্ষতির মাধ্যমে এবং ফল-শস্যাদি বিনষ্টের মাধ্যমে’ (বাক্বারাহ ২/১৫৫)।
সুতরাং আমরা যদি বিপদাপদকে সর্বোত্তমভাবে আলিঙ্গন করতে পারি তবেই আল্লাহর পক্ষ থেকে কল্যাণের স্বাদ আস্বাদন করতে পারব ইনশাআল্লাহ।
আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
إِذَا أَرَادَ اللهُ بِعَبْدِهِ الْخَيْرَ عَجَّلَ لَهُ الْعُقُوبَةَ فِى الدُّنْيَا وَإِذَا أَرَادَ اللهُ بِعَبْدِهِ الشَّرَّ أَمْسَكَ عَنْهُ بِذَنْبِهِ حَتَّى يُوَفَّى بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَإِنَّ اللهَ إِذَا أَحَبَّ قَوْمًا ابْتَلاَهُمْ فَمَنْ رَضِىَ فَلَهُ الرِّضَا وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السَّخَطُ-
‘আল্লাহ তা‘আলা যখন তাঁর কোন বান্দার মঙ্গল সাধনের ইচ্ছা করেন তখন দুনিয়ায় তাকে অতি তাড়াতাড়ি বিপদাপদের সম্মুখীন করেন। আর যখন তিনি কোন বান্দার অকল্যাণের ইচ্ছা করেন তখন তার গুনাহের শাস্তি প্রদান থেকে বিরত থাকেন। অবশেষে ক্বিয়ামতের দিন তাকে এর পরিপূর্ণ শাস্তি প্রদান করেন। আর আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন সম্প্রদায়কে ভালবাসেন তখন তাদের তিনি পরীক্ষায় ফেলেন। যে তাতে সন্তুষ্ট থাকে তার জন্য (আল্লাহর) সন্তুষ্টি থাকে আর যে তাতে অসন্তুষ্ট হয় তার জন্য (আল্লাহর) অসন্তুষ্টি থাকে’।[1]
বিপদাপদ জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম : বিপদাপদে পড়লে গোনাহ মাফ হয়। তাই এটা জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহ বলেন,أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُواْ الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِينَ خَلَوْاْ مِن قَبْلِكُم مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاء وَالضَّرَّاء وَزُلْزِلُواْ حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُواْ مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللهِ أَلا إِنَّ نَصْرَ اللهِ قَرِيبٌ- ‘তোমরা কি ধারণা করেছ জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের উপর এখনও তাদের মত অবস্থা আসেনি, যারা তোমাদের পূর্বে বিগত হয়েছে। নানাবিধ বিপদ ও দুঃখ-কষ্ট তাদেরকে স্পর্শ করেছিল ও তারা ভীত-কম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তার সাথী মুমিনগণ বলতে বাধ্য হয়েছিল যে, কখন আল্লাহর সাহায্য আসবে? জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতীব নিকটবর্তী’ (বাক্বারাহ ২/২১৪)।
(৪) নেককার ব্যক্তিদের বিপদে ফেলেন :
আল্লাহ তা‘আলা কোন নেককার ব্যক্তির কল্যাণ চাইলে তাকে বিপদে ফেলেন। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، قَالَ دَخَلْتُ عَلَى النَّبِيّ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ يُوعَكُ فَوَضَعْتُ يَدِي عَلَيْهِ فَوَجَدْتُ حَرَّهُ بَيْنَ يَدَىَّ فَوْقَ اللِّحَافِ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ مَا أَشَدَّهَا عَلَيْكَ قَالَ إِنَّا كَذَلِكَ يُضَعَّفُ لَنَا الْبَلاَءُ وَيُضَعَّفُ لَنَا الأَجْرُ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ أَىُّ النَّاسِ أَشَدُّ بَلاَءً قَالَ الأَنْبِيَاءُ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ ثُمَّ مَنْ قَالَ ثُمَّ الصَّالِحُونَ إِنْ كَانَ أَحَدُهُمْ لَيُبْتَلَى بِالْفَقْرِ حَتَّى مَا يَجِدُ أَحَدُهُمْ إِلاَّ الْعَبَاءَةَ يُحَوِّيهَا وَإِنْ كَانَ أَحَدُهُمْ لَيَفْرَحُ بِالْبَلاَءِ كَمَا يَفْرَحُ أَحَدُكُمْ بِالرَّخَاءِ-
‘আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে ছিলাম, তখন তিনি ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। আমি তাঁর উপর আমার হাত রাখলে তাঁর গায়ের চাদরের উপর থেকেই তাঁর দেহের প্রচন্ড তাপ অনুভব করলাম। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কত তীব্র জ্বর আপনার। তিনি বললেন, আমাদের (নবী-রাসূলগণের) অবস্থা এমনই হয়ে থাকে। আমাদের উপর দ্বিগুণ বিপদ আসে এবং দ্বিগুণ পুরস্কারও দেয়া হবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কার উপর সর্বাধিক কঠিন বিপদ আসে? তিনি বলেন, নবীগণের উপর। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তারপর কার উপর? তিনি বললেন, তারপর নেককার বান্দাদের উপর। তাদের কেউ এতটা দারিদ্র্যপীড়িত হয় যে, শেষ পর্যন্ত তার কাছে তার পরিধানের কম্বলটি ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তাদের কেউ বিপদে এত শান্ত ও উৎফুল্ল থাকে, যেমন তোমাদের কেউ ধন-সম্পদ প্রাপ্তিতে আনন্দিত হয়ে থাকে’।[2] অপর এক হাদীছে এসেছে,
عَنْ مُصْعَبِ بْنِ سَعْدٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ أَىُّ النَّاسِ أَشَدُّ بَلاَءً قَالَ الأَنْبِيَاءُ ثُمَّ الأَمْثَلُ فَالأَمْثَلُ فَيُبْتَلَى الرَّجُلُ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ فَإِنْ كَانَ دِينُهُ صُلْبًا اشْتَدَّ بَلاَؤُهُ وَإِنْ كَانَ فِي دِينِهِ رِقَّةٌ ابْتُلِيَ عَلَى حَسَبِ دِينِهِ فَمَا يَبْرَحُ الْبَلاَءُ بِالْعَبْدِ حَتَّى يَتْرُكَهُ يَمْشِي عَلَى الأَرْضِ مَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ-
‘মুছ‘আব ইবন সা‘দ তার পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশী মুছীবতের সম্মুখীন হয় কে? তিনি বললেন, নবীগণ, এরপর যারা ভাল মানুষ তারা, এরপর যারা ভাল তারা। একজন তার দ্বীনদারীর অনুপাতে পরীক্ষায় নিপতিত হয়। যদি সে তার দ্বীনে মযবূত হয় তবে তার পরীক্ষাও তুলনামূলকভাবে কঠিন হয়; আর যদি সে দ্বীনের ক্ষেত্রে দুর্বল ও হালকা হয়, তবে সে তার দ্বীনদারীর অনুপাতেই পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। এভাবে বান্দা বিপদাপদে পড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত সে পৃথিবীতে এমনভাবে বিচরণ করতে থাকে যে, তার উপর আর কোন গুনাহ থাকে না’।[3]
(৫) তাক্বওয়াশীল করে নেন :
তাক্বওয়া একটি মহৎ গুণ। এই গুণ শুধুমাত্র তারা লাভ করতে পারে, আল্লাহ যাদের কল্যাণ চান। আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إذا أرَادَ الله بِعَبْدٍ خَيْراً جَعَلَ غِناهُ في نَفْسِهِ وتُقاهُ في قَلْبِهِ وإذا أرَادَ الله بِعَبْدٍ شَرًّا جَعَلَ فَقْرَهُ بَيْنَ عَيْنَيْهِ- ‘আল্লাহ যখন কোন বান্দার কল্যাণ চান তখন তার অন্তর ধনী করে দেন এবং তার অন্তরে তাক্বওয়া দান করেন। আর আল্লাহ যার অকল্যাণ চান তখন তার সামনে দরিদ্রতা ছড়িয়ে দেন’।[4]
(৬) সত্যবাদী ও ন্যায়পরায়ণ সঙ্গী দেন :
আল্লাহ যখন কোন নেতার কল্যাণ চান তখন তার উত্তম সঙ্গী দান করেন।
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا أَرَادَ اللهُ بِالأَمِيرِ خَيْرًا جَعَلَ لَهُ وَزِيرَ صِدْقٍ إِنْ نَسِىَ ذَكَّرَهُ وَإِنْ ذَكَرَ أَعَانَهُ وَإِذَا أَرَادَ اللهُ بِهِ غَيْرَ ذَلِكَ جَعَلَ لَهُ وَزِيرَ سُوءٍ إِنْ نَسِىَ لَمْ يُذَكِّرْهُ وَإِنْ ذَكَرَ لَمْ يُعِنْهُ-
‘আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন নেতার জন্য কল্যাণের ফায়ছালা করেন, তখন তিনি তাকে সত্যবাদী, ন্যায়নিষ্ঠ উযীর দান করেন। যদি তিনি (নেতা) কিছু ভুলে যান, তখন সে (উযীর) তাকে তা স্মরণ করিয়ে দেয়। আর আমীর যদি তা স্মরণ রাখেন, তখন উযীর তাকে সাহায্য করে। পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলা কোন নেতার জন্য অকল্যাণের ফায়ছালা করলে তাকে অযোগ্য উযীর দান করেন। ফলে যখন তিনি (নেতা) কিছু ভুলে যান, তখন সে (উযীর) তাকে তা স্মরণ করিয়ে দেয় না। আর নেতা যদি স্মরণ রাখেন, তখন সে তাকে সাহায্য করে না’।[5]
(৭) দ্বীনের জ্ঞান দান করেন :
আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন। মু‘আবিয়া (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,عَنْ مُعَاوِيَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِ وَإِنَّمَا أَنَا قَاسِمٌ وَاللهِ يُعْطِي- ‘আল্লাহ তা‘আলা যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের প্রজ্ঞা দান করেন। আল্লাহই দানকারী আর আমি বণ্টনকারী’।[6]
এই দ্বীনী জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর মানোনীত বান্দাই লাভ করে থাকে। মহান আল্লাহ বলেন,يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيْرًا، ‘আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিশেষ প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে উক্ত প্রজ্ঞা দান করা হয়, তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়। বস্ত্ততঃ জ্ঞানবান ব্যক্তিগণ ব্যতীত কেউই উপদেশ গ্রহণ করে না’ (বাক্বারাহ ২/২৬৯)।
আর এই পথে চলার মর্যাদাও অপরিসীম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ خَرَجَ فِى طَلَبِ الْعِلْمِ فَهُوَ فِى سَبِيلِ اللهِ حَتَّى يَرْجِعَ، ‘যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য বের হয়েছে, সে ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহর পথেই রয়েছে’।[7]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ وَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ وَإِنَّ طَالِبَ الْعِلْمِ يَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِى السَّمَاءِ وَالأَرْضِ حَتَّى الْحِيتَانِ فِى الْمَاءِ وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ إِنَّ الْعُلَمَاءَ هُمْ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ إِنَّ الأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوا دِينَارًا وَلاَ دِرْهَمًا إِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ-
‘যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের কোন পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের দিকে একটি পথ সুগম করে দেন। ফেরেশতাগণ জ্ঞান অন্বেষণকারীর সন্তুষ্টির জন্য তাদের পাখাসমূহ বিছিয়ে দেন। আর জ্ঞান অন্বেষণকারীর জন্য আসমান ও যমীনবাসী আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, এমনকি পানির মধ্যের মাছও। নিশ্চয়ই কোন আবেদের উপর আলেমের মর্যাদা তারকারাজির উপর চাঁদের মর্যাদার সমতুল্য। আলেমগণ নবীগণের ওয়ারিছ। আর নবীগণ কোন দীনার ও দিরহাম (নগদ অর্থ) উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে যাননি, বরং তাঁরা রেখে গেছেন ইলম (জ্ঞান)। যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করল, সে যেন পূর্ণ অংশ লাভ করল’।[8]
(৮) দুনিয়ায় শাস্তি ভোগ করান :
যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা তাদেরকে তিনি দুনিয়াতেই কিছু শাস্তি ভোগ করান। যাতে পরকালে তাঁর সেই বান্দাকে শাস্তি ভোগ করতে না হয়। আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا أَرَادَ اللهُ بِعَبْدِهِ الْخَيْرَ عَجَّلَ لَهُ الْعُقُوبَةَ فِى الدُّنْيَا وَإِذَا أَرَادَ اللهُ بِعَبْدِهِ الشَّرَّ أَمْسَكَ عَنْهُ بِذَنْبِهِ حَتَّى يُوَفَّى بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘আল্লাহ তা‘আলা যখন তার বান্দার মঙ্গল কামনা করেন তখন দুনিয়ায় তাকে অতি তাড়াতাড়ি বিপদাপদের সম্মুখীন করা হয়। আর যখন তিনি কোন বান্দার অকল্যাণের ইচ্ছা করেন তখন তিনি তার গুনাহের শাস্তি প্রদান থেকে বিরত থাকেন। অবশেষে ক্বিয়ামতের দিন তাকে এর পরিপূর্ণ আযাবে নিপতিত করেন’।[9]
(৯) বান্দার দেহ, সম্পদ ও সন্তানদের বিপদগ্রস্ত করেন :
আল্লাহ যে ব্যক্তির কল্যাণ চান, তার নিজের এবং সম্পদ ও সন্তানের উপরে বিপদ দেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا سَبَقَتْ لَهُ مِنَ اللهِ مَنْزِلَةٌ لَمْ يَبْلُغْهَا بِعَمَلِهِ ابْتَلاَهُ اللهُ فِى جَسَدِهِ أَوْ فِى مَالِهِ أَوْ فِى وَلَدِهِ قَالَ أَبُودَاوُدَ زَادَ ابْنُ نُفَيْلٍ ثُمَّ صَبَّرَهُ عَلَى ذَلِكَ ثُمَّ اتَّفَقَا حَتَّى يُبْلِغَهُ الْمَنْزِلَةَ الَّتِى سَبَقَتْ لَهُ مِنَ اللهِ تَعَالَى- ‘কোন ব্যক্তির জন্য বিনাশ্রমে আল্লাহর পক্ষ থেকে মর্যাদার আসন নির্ধারিত হ’লে আল্লাহ তার দেহ, সম্পদ অথবা সন্তানকে বিপদগ্রস্ত করেন। অতঃপর সে তাতে ধৈর্যধারণ করলে শেষ পর্যন্ত বরকতময় মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত উক্ত মর্যাদার স্তরে উপনীত হয়’।[10]
(১০) ব্যক্তির মধ্যে নম্রতার উদ্রেক ঘটান :
আল্লাহ নম্রতাকে ভালোবাসেন। আর তিনি যার কল্যাণ চান তাকেই এই গুণটি দান করেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِذَا أَرَادَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ بِأَهْلِ بَيْتٍ خَيْرًا أَدْخَلَ عَلَيْهِمُ الرِّفْقَ ‘আল্লাহ যখন কোন আহলে বাইতের কল্যাণ চান তখন তার মধ্যে নম্রতার উদ্রেক ঘটান’।[11]
(১১) মৃত্যুর পূর্বে নেক আমলের সুযোগ দান করেন :
আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে তার জীবদ্দশায় সৎকাজ করার তাওফীক দান করেন। إِذَا أَرَادَ اللهُ بِعَبْدٍ خَيْرًا طَهَّرَهُ قَبْلَ مَوْتِهِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ، وَمَا طَهُورُ الْعَبْدِ؟ قَالَ عَمَلٌ صَالِحٌ يُلْهِمُهُ إِيَّاهُ، حَتَّى يَقْبِضَهُ عَلَيْهِ- ‘আল্লাহ যখন কোন বান্দার কল্যাণের ইচ্ছা করেন তখন তাকে মৃত্যুর পূর্বে পবিত্র করেন। লোকেরা জিজ্ঞেস করল, পবিত্র করেন কিভাবে? তিনি বললেন, মৃত্যুর পূর্বে তাকে নেক আমলের তাওফীক দেন। অতঃপর তার উপর তার মৃত্যু ঘটান’।[12] আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত অপর হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
إِذَا أَرَادَ اللهُ بِعَبْدٍ خَيْرًا اسْتَعْمَلَهُ فَقِيلَ كَيْفَ يَسْتَعْمِلُهُ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ يُوَفِّقُهُ لِعَمَلٍ صَالِحٍ قَبْلَ الْمَوْتِ-
‘আল্লাহ তা‘আলা যখন তাঁর বান্দা সম্পর্কে কল্যাণের ইচ্ছা করেন তখন তাকে আমল করতে দেন। বলা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! কিভাবে তিনি আমল করতে দেন? তিনি বলেন, মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাকে নেক আমলের তাওফীক দান করেন’।[13]
অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِذَا أَرَادَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ بِعَبْدٍ خَيْراً عَسَلَهُ قِيلَ وَمَا عَسَلُهُ قَالَ يَفْتَحُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُ عَمَلاً صَالِحاً قَبْلَ مَوْتِهِ ثُمَّ يَقْبِضُهُ عَلَيْهِ، ‘আল্লাহ যখন কোন বান্দার কল্যাণ চান তখন সে বান্দাকে সুমিষ্ট করেন। জিজ্ঞেস করা হলো সুমিষ্ট কী? তিনি বললেন, মৃত্যুর পূর্বে ভাল কাজ তার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। অতঃপর এর উপরই তার মৃত্যু হয়’।[14]
বিপদ-মুছীবতে পড়লে করণীয় :
(১) আল্লাহর উপর ভরসা করা : বিপদাপদ, কষ্ট-ক্লেশ যাই আসুক না কেন সর্বদা আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে। কেননা এসব কিছু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। আল্লাহ বলেন,قُلْ لَنْ يُصِيبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ اللهُ لَنَا هُوَ مَوْلَانَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ- ‘তুমি বল, আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন, তা ব্যতীত কিছুই আমাদের নিকট পৌঁছবে না। তিনিই আমাদের অভিভাবক। আর আল্লাহর উপরেই মুমিনদের ভরসা করা উচিত’ (তওবা ৯/৫১)।
(২) আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট থাকা : আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার উপর যা কিছু আপতিত হবে, তার উপর সন্তুষ্ট থাকতে হবে। তবেই প্রকৃত প্রতিদান পাওয়া যাবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ عِظَمَ الْجَزَاءِ مَعَ عِظَمِ الْبَلاَءِ وَإِنَّ اللهَ إِذَا أَحَبَّ قَوْمًا ابْتَلاَهُمْ فَمَنْ رَضِىَ فَلَهُ الرِّضَا وَمَنْ سَخِطَ فَلَهُ السَّخَطُ ‘বিপদাপদ যত বড় হয় তার প্রতিদানও তত বড় হয়। আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন সম্প্রদায়কে ভালবাসেন তখন তিনি তাদের পরীক্ষায় ফেলেন। যে তাতে সন্তুষ্ট থাকবে তার জন্য
(আল্লাহর) সন্তুষ্টি আর তাতে যে অসন্তুষ্ট হবে তার জন্য (আল্লাহর) অসন্তুষ্টি’।[15]
(৩) ধৈর্যধারণ করা :
সুহায়েব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ- ‘মুমিনের বিষয়টি বিস্ময়কর। তার যাবতীয় ব্যাপারই তার জন্য কল্যাণকর। এ বৈশিষ্ট্য মুমিন ছাড়া অন্য কারো নেই। যদি তার সুখ-শান্তি আসে তবে সে শুকরিয়া আদায় করে, আর যদি দুঃখ-মুছীবত আসে তখন সে ছবর করে। অতএব প্রত্যেকটিই তার জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে’।[16] আর ধৈর্যশীল ব্যক্তিদের প্রতিদান সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يُوَفَّى الصَّابِرُونَ أَجْرَهُم بِغَيْرِ حِسَابٍ ‘নিঃসন্দেহে ধৈর্যশীলগণ তাদের পুরষ্কার পাবে অপরিমিতভাবে’ (যুমার ৩৯/১০)।
উপসংহার :
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘জাহান্নাম কামনা-বাসনা দ্বারা বেষ্টিত। আর জান্নাত বেষ্টিত দুঃখ-মুছীবত দ্বারা’।[17] ‘কোন মুসলমানের গায়ে একটি কাটাও বিদ্ধ হয় না, যার বিনিময়ে তার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি পায় না এবং তার একটি গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয় না’।[18] সুতরাং পরকালীন চিরস্থায়ী জীবনে সুখ-শান্তির স্বার্থে দুনিয়ার যেকোন বিপদাপদে আমাদেরকে ছবর করতে হবে। আললাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে জান্নাত লাভের স্বার্থে কাজ করার তওফীক দান করুন-আমীন!
[1]. তিরমিযী হা/২৩৯৬; ছহীহাহ হা/১২২০; মিশকাত হা/১৫৬৫।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/৪০২৪।
[3]. তিরমিযী হা/২৩৯৮।
[4]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬২১৭; ছহীহাহ হা/৩৩৫০।
[5]. আবূদাঊদ হা/২৯৩২; ছহীহাহ হা/১৫৫১; মিশকাত হা/৩৭০৭।
[6]. বুখারী হা/৭১; মুসলিম হা/১০৩৭; মিশকাত হা/২০০।
[7]. তিরমিযী হা/২৬৪৭; ছহীহুত তারগীব হা/৮৮।
[8]. ইবনু মাজাহ হা/২২৩; তিরমিযী হা/২৬৪৬; আবূ দাঊদ হা/৩৬৪১।
[9]. তিরমিযী হা/২৩৯৬।
[10]. আবূদাঊদ হা/৩০৯০।
[11]. আহমাদ হা/২৪৪৭১; ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৯; ছহীহাহ হা/১২১৯।
[12]. ছহীহুল জামে‘ হা/ ৩০৬।
[13]. তিরমিযী হা/২১৪২; মিশকাত হা/৫২৮৮।
[14]. আহমাদ হা/১৭৮১৯; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩৪২; ছহীহাহ হা/১১১৪।
[15]. তিরমিযী হা/২৩৯৬।
[16]. মুসলিম হা/২৯৯৯।
[17]. বুখারী হা/৬৪৮৭।
[18]. মুসিলম হা/২৫৭২।