পানিতে রুকিয়া বা ঝাড়ফুঁক করে তা পান করা বা তা দ্বারা গোসল করার বিধান এবং এ সংক্রান্ত একটি ভ্রান্তি নিরসন
▬▬▬◄❖►▬▬▬
প্রশ্ন: আমার একটু সমস্যার কারণে আমি রুকিয়া (ঝাড়ফুঁক) করতে চাই। এখন রুকিয়া করার জন্য কি দোয়া পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে তা পান করা বা গোসল করা কি জায়েজ?
উত্তর:
রুকিয়া বা ঝাড়ফুঁক করার জন্য কুরআনের নির্দিষ্ট সূরা, আয়াত ও হাদিসে বর্ণিত দুআগুলো পানিতে পড়ে তা ব্যবহার করা যাবে কি না সে বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। তবে একদল মুহাক্কিক আলেম জায়েজ বলেছেন। যেমন: শাইখ আব্দুল্লাহ বিন বায (মজমু ফতোয়া বিন বায ১/৫২)
পানি পড়ার বৈধতার পক্ষে শাইখ সালিহ আল ফাউযান, শাইখ বকর আবু যায়েদ, শাইখ গুগাইয়ান, আব্দুল আযীয আলুশ শাইখ প্রমুখদেরও ফতোয়া রয়েছে।
এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে, সাবিত বিন কায়েস বিন শাম্মাস রা. অসুস্থ হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নিকটে গিয়ে পানিতে দুয়া পড়ে তা তার শরীরে ছিটিয়ে দিয়েছিলেন।” (সুনানে আবু দাউদ, কিতাবতুত ত্বিব-সংক্ষেপিত)
পূর্ণ হাদিসটি নিম্নরূপ:
عَنْ ثَابِتِ بْنِ قَيْسِ بْنِ شَمَّاسٍ عَنْ أَبِيهِ، عَنْ جَدِّهِ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَنَّهُ دَخَلَ عَلَى ثَابِتِ بْنِ قَيْسٍ – قَالَ: أَحْمَدُ وَهُوَ مَرِيضٌ – فَقَالَ: «اكْشِفِ الْبَأْسَ رَبَّ النَّاسِ عَنْ ثَابِتِ بْنِ قَيْسِ بْنِ شَمَّاسٍ» ثُمَّ أَخَذَ تُرَابًا مِنْ بَطْحَانَ فَجَعَلَهُ فِي قَدَحٍ ثُمَّ نَفَثَ عَلَيْهِ بِمَاءٍ وَصَبَّهُ عَلَيْهِ
[حكم الالبانى] : ضعيف الإسناد
মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ ইবনে সাবিত ইবনে কায়িস ইবনে শাম্মাস রা. থেকে তার পিতা ও দাদার সূত্রে বর্ণিত। একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবিত ইবনে কায়িস রা.-এর নিকট গেলেন। (আহমাদ বলেন, তিনি তখন অসুস্থ ছিলেন।)
তিনি বললেন,
«اكْشِفِ الْبَأْسَ رَبَّ النَّاسِ عَنْ ثَابِتِ بْنِ قَيْسِ بْنِ شَمَّاسٍ»
“হে মানুষের রব, সাবিত ইবনে কায়িস ইবনে শাম্মাসের রোগ দূর করে দিন।”
অতঃপর তিনি বাতহান নামক উপত্যকার কিছু ধুলোমাটি নিয়ে একটি পাত্র রাখলেন এবং পানিতে মিশিয়ে তার দেহে ঢেলে দিলেন।
[এ হাদিসটিকে শাইখ আলবানী জইফ/দুর্বল বলেছেন। সূত্র: যাঈফ আবু দাউদ, হা/৩৮৮৫]
◍ আল্লামা উসাইমিন বলেন, “কাগজে কুরআনের আয়াত লিখে তা পানিতে ডুবিয়ে পান করা অথবা কোনও পাত্রের মধ্যে রেখে তাতে পানি দেয়ার পর ঝাঁকিয়ে পান করা অথবা পানিতে কুরআন পড়ে ফুঁ দিয়ে পান করা…এসব বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোনও সুন্নত আছে বলে জানি না। তবে তিনি এও বলেন যে, এ বিষয়ে কোনও হাদিস না থাকলেও সালাফদের আমল আছে। এটি পরীক্ষিত বিষয়। তাই তাতে অসুবিধা নেই।”
তিনি আরও বলেন,
ﺃﻥ ﻳﻨﻔﺚ ﺍﻹﻧﺴﺎﻥ ﺑﺮﻳﻖ ﺗﻼ ﻓﻴﻪ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ ﺍﻟﻜﺮﻳﻢ ﻣﺜﻞ ﺃﻥ ﻳﻘﺮﺃ
ﺍﻟﻔﺎﺗﺤﺔ ﻭﺍﻟﻔﺎﺗﺤﺔ ﺭﻗﻴﺔ ﻭﻫﻲ ﻣﻦ ﺃﻋﻈﻢ ﻣﺎ ﻳﺮﻗﻰ ﺑﻪ ﺍﻟﻤﺮﻳﺾ ﻓﻴﻘﺮﺃ ﺍﻟﻔﺎﺗﺤﺔ
ﻭﻳﻨﻔﺚ ﻓﻲ ﺍﻟﻤﺎﺀ ﻓﺈﻥ ﻫﺬﺍ ﻻ ﺑﺄﺱ ﺑﻪ ﻭﻗﺪ ﻓﻌﻠﻪ ﺑﻌﺾ ﺍﻟﺴﻠﻒ ﻭﻫﻮ ﻣﺠﺮﺏ
ﻭﻧﺎﻓﻊ ﺑﺈﺫﻥ ﺍﻟﻠﻪ ﻭﻗﺪ ﻛﺎﻥ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻَﻠَّﻰ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻪِ ﻭَﺳَﻠَّﻢَ ﻳﻨﻔﺚ ﻓﻲ ﻳﺪﻳﻪ ﻋﻨﺪ
ﻧﻮﻣﻪ ﺏ } ﻗﻞ ﻫﻮ ﺍﻟﻠﻪ ﺃﺣﺪ{ ، ﻭ } ﻗﻞ ﺃﻋﻮﺫ ﺑﺮﺏ ﺍﻟﻔﻠﻖ { ، ﻭ } ﻗﻞ ﺃﻋﻮﺫ ﺑﺮﺏ
ﺍﻟﻨﺎﺱ { ﻓﻴﻤﺴﺢ ﺑﻬﻤﺎ ﻭﺟﻬﻪ ﻭﻣﺎ ﺍﺳﺘﻄﺎﻉ ﻣﻦ ﺟﺴﺪﻩ ﺻﻠﻮﺍﺕ ﺍﻟﻠﻪ ﻭﺳﻼﻣﻪ
◍ শাইখ আলবানি বলেন, “কুরআন তিলাওয়াত ছাড়া কোনও রুকিয়া (ঝাড়ফুঁক) নেই। সুন্নত হল, তিলাওয়াত ছাড়া রুকিয়া নেই। কিন্তু তা কাগজে লিখে তা পানি দ্বারা ধোয়ার ব্যাপারে কোনো কোনো আলেম জায়েজ বললেও আমরা হাদিসে এর কোনও দলিল পাই নি।”
যাহোক, প্রথমোক্ত আলেমদের মতে রুকিয়া কৃত (সূরা বা দুআ পড়া) পানি রোগীর পান করা বা তা দ্বারা গোসল করা জায়েজ ইনশাআল্লাহ। এমন কি রোগী ঋতুমতী হলেও আপত্তি নাই।
তবে সবচেয়ে সঠিক নিয়ম হল, ঝাড়ফুঁকের সূরা, আয়াত ও দুয়াগুলো পড়ে রোগী নিজেই নিজের শরীরে ফুঁ দিবে অথবা অন্য কেউ পড়ে রোগীর গায়ে ফুঁ দিবে। এ মর্মে একাধিক সহীহ বর্ণিত হয়েছে এবং সেগুলোতে কোনও দ্বিমত নাই।
কিন্তু পানিতে পড়ে রোগীর গায়ে ছিটা দেয়া, পান করতে বলা বা গোসল করাতে বলার বিষয়টি মত বিরোধপূর্ণ। কেননা, এ মর্মে বর্ণিত হাদিসটি অনেক মুহাদ্দিসের মতে জঈফ-যেমনটি উপরে উল্লেখিত হয়েছে।
◈◈ পানিতে দম করার সঠিক নিয়ম এবং প্রচলিত ফুঁ দেয়ার পদ্ধতিগত ভ্রান্তি:
কুরআনের নির্দিষ্ট আয়াত, সুরা এবং হাদিসে বর্ণিত দুআ পড়ে পানিতে ফুঁ দেয়া ঠিক নয়। কারণ হাদিসে খাদ্য-পানীয় দ্রব্যে বা পানাহারের পাত্রে ফুঁ দেয়া নিষেধ। যেমন: ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত,
نَهَى أَنْ يُتَنَفَّسَ فِي الإِنَاءِ أَوْ يُنْفَخَ فِيهِ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানপাত্রে নিঃশ্বাস ফেলতে বা তাতে ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন।” [তিরমিযী হাসান সহীহ, তিরমিযী ১৮৮৮, আবু দাউদ ৩৭২৮, ইবনে মাজাহ ৩৪২৯- রিয়াদুস সালেহীন, অধ্যায়: ২/ পানাহারের আদব-কায়দা, পরিচ্ছেদ: ১১৩: পানি পান করার সময় তাতে ফুঁ দেওয়া মাকরূহ]
তবে (বৈধতার পক্ষের অভিমতকে গ্রহণ করলে) আয়াত বা দুআ পড়ে এমনভাবে পানিতে দম করবে যে, মুখ থেকে হালকা বাতাস বের হবে কিন্তু তার সাথে মোটেও থুথু বের হবে না বা হলেও খুবই সামান্য। আরবিতে এটাকে نفث বলা হয়।
ইবনুল আসির বলেন,
النفث : نفخ يسير مع ريق يسير وهو أقل من التفل وقيل أنه بلا ريق
( النهاية في غريب الحديث – 5 / 88)
ইবনুল আসির বলেন, “نفث বলা হয়, সামান্য মুখের লালা (যা থুথু থেকে কম) সহকারে হালকা বাতাস অথবা বলা হয়েছে, লালা বিহীন হালকা বাতাস।”
[আন নিহায়াহ ফী গারিবিল হাদিস ৫/৮৮] আর পানিতে দম করার ব্যাপারে হাদিসে এই نفث শব্দটি এসেছে। (পূর্বোল্লিখিত সাবিত বি কায়েস রা. এর হাদিস)
সুতরাং আমাদের সমাজে অনেক রুকিয়া কারী (ঝাড়ফুঁক কারী) বা কথিত কবিরাজ যেভাবে পানি বা খাদ্যদ্রব্যে জোরে জোরে ফুঁ দেয় বা এমনভাবে ফুঁ দেয় যে, মুখ থেকে গরম বাতাস বের হয়ে আসে তা হাদিস পরিপন্থী। বরং তা নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। এটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কারণ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য নাক ও মুখ দিয়ে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে। নিঃশ্বাসে থাকে দেহের দূষিত বাষ্প ও রোগ-জীবাণুবাহী অপেক্ষাকৃত ভারী বায়বীয় পদার্থ কার্বন ডাই-অক্সাইড, যা খাবার কিংবা পানির সঙ্গে মিশে আবার মানুষের দেহের ভেতরে প্রবেশ করে। ফলে শরীরে বিভিন্ন রোগ-জীবাণুর আস্তানা গড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
আল্লাহু আলাম।
▬▬▬◄❖►▬▬▬
উত্তর প্রদানে:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স, মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদি আরব।
আসসালামু আলাইকুম ওয়ারহমাতুল্লাহ। আভাস মাল্টিমিডিয়া.কম এ ওয়েবসাইটটি সম্পূর্ণরূপে বিশুদ্ধ ঈমান ও আমলের দাওয়াতী ওয়েবসাইট। এটি সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত এবং কোন প্রকার দল / সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত নয়। আমাদের আক্বীদাহ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাহ। আমাদের মানহাজ সালাফে সালেহীনদের মানহাজ। আমাদের দাওয়াত শিরকমুক্ত, কুফরমুক্ত, নিফাক্বমুক্ত ও বিদ‘আতমুক্ত ঈমান ও আমলের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাওহীদ ও সুন্নাত ভিত্তিক ঈমান ও আমল গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।
Leave a Reply