ভূমিকা: রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস পবিত্র মাহে রমজান শেষের পথে। সিয়াম সাধনা ও ইবাদতে পবিত্র একটি বসন্ত গড়ালেন মুমিন বান্দারা। রমজান এসেছিল আমাদের ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে পরিশুদ্ধ করার জন্য। বহুবিধ শিক্ষায় পরবর্তী জীবনধারা ইসলামের রঙে রাঙাতে যার জুড়ি মেলা ভার। তাই পবিত্র মাহে রমজান থেকে আমরা কি শিক্ষা নিতে পারি তা আজকের লেখনিতে তুলে ধরব ইনশা আল্লাহ্ ।
১। তাকওয়া অর্জন:
সিয়াম আমাদের তাকওয়া অর্জনের শিক্ষা দেয়। আল্লাহতায়ালা বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ ﴿۱۸۳﴾ۙ
‘হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)। এ আয়াতের মাধ্যমে বোঝা গেল, সিয়ামের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে তাকওয়া অবলম্বনে অভ্যস্ত করানো। তাকওয়া মানে, আল্লাহতায়ালার ভয়ে যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচার ও পাপকাজ থেকে বিরত থাকা। তাকওয়া মুমিনের জীবনের আবশ্যকীয় অংশ। তাকওয়া ছাড়া মানুষ মুমিন হতে পারে না।
২। ইখলাস তথা একনিষ্ঠতা:
সিয়াম একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই মানুষ রেখে থাকে। কেননা, মানুষ চাইলে লোকচক্ষুর অন্তরালে পানাহার করতে পারে; কিন্তু তা করে না। সে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে। এটাকেই ইখলাস বলে। আর আমল গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য ইখলাস পূর্বশর্ত। সিয়াম আমাদের এই ইখলাস অর্জন করতে শেখায়। এ কারণেই হাদীসে কুদসিতে আসছে,
أَبَا هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم “ قَالَ اللَّهُ كُلُّ عَمَلِ ابْنِ آدَمَ لَهُ إِلاَّ الصِّيَامَ، فَإِنَّهُ لِي، وَأَنَا أَجْزِي بِهِ.
‘আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, সাওম (রোযা/রোজা/সিয়াম/ছিয়াম) ব্যতীত আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তাঁর নিজের জন্য, কিন্তু সিয়াম আমার জন্য, তাই আমিই এর প্রতিদান দেব।’ (বুখারি : ১৯০৪)।
৩। সহমর্মী হওয়া:
রমজান সহমর্মিতার মাস। ধনাঢ্য ব্যক্তি যখন সিয়াম রাখেন, তখন তিনি বুঝতে পারেন, উপবাস থাকার যন্ত্রণা কত কষ্টদায়ক! তখন তিনি দরিদ্রদের প্রতি সহমর্মী হন। রমজানের পরে বাকি সময়ও যেন আমরা সহমর্মী হই, সে শিক্ষাই সিয়াম আমাদের দেয়। এ কারণেই দানশীল হওয়া সত্ত্বেও রাসুল (সা.) রমজানে অধিক পরিমাণে দান করতেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল। আর রমাজানে তার এ দানশীলতা আরও বেড়ে যেত।’ (বুখারি : ১৯০২)।
৪। পরনিন্দা পরিহার:
সিয়াম আমাদের পরনিন্দা, গিবত-শেয়ায়েত থেকে বিরত থাকতে শেখায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সিয়াম হলো ঢাল, যে পর্যন্ত না তাকে বিদীর্ণ করা হয়।’ জিজ্ঞেস করা হলো, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! কীভাবে সিয়াম বিদীর্ণ হয়ে যায়?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘মিথ্যা বলার দ্বারা অথবা গিবত করার দ্বারা।’ (সুনানে নাসাঈ : ২২৩৫)। গিবত বা পরনিন্দা সবসময়ই নিন্দনীয় ও মহাপাপ। তাই শুধু রমজানেই নয়, সারা জীবনের জন্য তা পরিত্যাগ করতে হবে। এ শিক্ষাই সিয়াম আমাদের দেয়।
৫। সংযমের শিক্ষা:
আঘাতেই প্রতিঘাতের জন্ম। সিয়াম আমাদের আঘাত করতে বারণ করে। শিক্ষা দেয় সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের। সিয়াম শেখায়, কেউ তোমাকে আঘাত করলেই তুমি তাকে প্রতিঘাত কোরো না; সংযমী হও। রাসুল (সা.) বলেন,
وَإِذَا كَانَ يَوْمُ صَوْمِ أَحَدِكُمْ، فَلاَ يَرْفُثْ وَلاَ يَصْخَبْ، فَإِنْ سَابَّهُ أَحَدٌ، أَوْ قَاتَلَهُ فَلْيَقُلْ إِنِّي امْرُؤٌ صَائِمٌ
‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি সিয়াম রাখে, সে যেন অশ্লীল কাজ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। সিয়াম রাখা অবস্থায় কেউ যদি তার সঙ্গে গালাগালি ও মারামারি করতে আসে, সে যেন বলে আমি একজন সায়িম।’ (মুসলিম : ১১৫১)। এ শিক্ষা যদি আমরা সারা জীবনের জন্য নিজেদের মাঝে ধারণ করি, তাহলে সমাজ হবে নির্মল, হানাহানি ও বিদ্বেষমুক্ত।
৬। আল্লাহভীতি:
সিয়াম আমাদের অন্তরে আল্লাহভীতি তৈরি করে। তাই গোপন জায়গায় থাকার পরও আমরা পানাহার থেকে বিরত থাকি। সিয়ামের এই একটিমাত্র শিক্ষা আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন, এই অনুভূতি সর্বদা আমাদের জাগ্রত থাকা আবশ্যক। আল্লাহতায়ালা বলেন,
وَ هُوَ مَعَکُمۡ اَیۡنَ مَا کُنۡتُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ
‘ তোমরা যেখানেই থাক তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন, তোমরা যে কাজই কর না কেন, আল্লাহ তা দেখেন।’ (সুরা হাদিদ : ৪)।
৭। মিথ্যা পরিত্যাগ:
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও অহেতুক কাজ বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বুখারি : ১৯০৩)। এ হাদিস থেকে আমরা জানতে পারলাম, শুধু পানাহার পরিত্যাগ করার নাম সিয়াম নয়, বরং মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করতে হবে। সিয়ামের এ শিক্ষা আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রয়োজন। কেননা, মিথ্যা মহাপাপ ও ধ্বংসের কারণ।
৮। অহেতুক কাজ বর্জন:
অনর্থক কথা-কাজ মুমিনের জন্য শোভনীয় নয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ব্যক্তির জন্য ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হলো, অর্থহীন কথা বা কাজ ত্যাগ করা।’ (তিরমিজি : ২৩১৭)। হাদিসটির ভাষ্য অনুযায়ী সিয়ামও আমাদের এ শিক্ষাই দেয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম নয়; বরং সব ধরনের অন্যায়, অহেতুক ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত থাকার নাম সিয়াম।’ (মুসতাদরাকে হাকেম : ১৫৭০)।
৯। ধৈর্য ধারণ করা:
রাসুল (সা.) রমজানকে সবর তথা ধৈর্যের মাস বলেছেন। আনন্দ, বেদনা, দুঃখ ও উদ্বেগ ইত্যাদি সময়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) কর্তৃক নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকাকে শরিয়তের পরিভাষায় ধৈর্য বলে। উপবাস থাকার কারণে সায়িম ব্যক্তির অনেক কষ্ট হয়। এর ওপর তাকে ধৈর্য ধারণ করতে হয়। এভাবে পূর্ণ এক মাস তাকে প্রস্তুত করা হয়। যেন সিয়ামের পরেও সে এ শিক্ষা ধরে রাখে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ধৈর্য ধারণের চেষ্টা করবে, আল্লাহ তাকে ধৈর্য ধারণের শক্তি দান করবেন। আর ধৈর্য অপেক্ষা অধিক উত্তম ও কল্যাণকর বস্তু আর কিছুই কাউকে দেওয়া হয়নি।’ (বুখারি : ১৪৬৯)।
১০। ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ:
সব মুসলমানের ওপর সিয়াম ফরজ। চাই সে বাদশা হোক কিংবা ফকির, কালো হোক কিংবা সাদা, খাটো হোক কিংবা লম্বা। সবাই একসঙ্গে সিয়াম রাখবে, একসঙ্গে তারাবি পড়বে, এটাই ইসলামের চাওয়া এবং সিয়ামের শিক্ষা। আর ঘটেও তাই। ফলে ধনী-গরিবের মাঝে তৈরি হয় ভ্রাতৃত্ববোধ ও একতা। তা ছাড়া ধনী-গরিবের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরির জন্য রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতর আবশ্যক করেছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতর অবধারিত করেছেন অশ্লীল কথা ও অর্থহীন কাজ হতে মাহে রমজানের সিয়ামকে পবিত্র করার জন্য এবং গরিব-মিসকিনদের খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৬০৯)।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, আমাদের কর্তব্য হলো, রমজানের এ শিক্ষাগুলো সবসময়ের জন্য নিজেদের মাঝে ধারণ করা। যদি আমরা তা করতে পারি, তাহলেই স্বার্থক হবে আমাদের সিয়াম সাধনা, স্বার্থক ও সুন্দর হবে জীবন।
কাজী আসাদ বিন রমজান
-লেখক, গবেষক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশ।
Leave a Reply