জিহাদের পরিচয়:
‘জিহাদ’ অর্থ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। শারঈ পরিভাষায় ‘জিহাদ’ হ’ল সমাজে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর রাস্তায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা যার চূড়ান্ত রূপ। জিহাদের উদ্দেশ্য হ’ল মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনা এবং মানুষে মানুষে সাম্য ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
জাহান্নামের কঠিন আযাব হ’তে বাঁচার দ্বিতীয় শর্ত হ’ল ‘জিহাদ’। যেমন আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيْكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيْمٍ – تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ وَتُجَاهِدُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ- (الصف 10-11)-
‘হে বিশ্বাসীগণ! আমি কি তোমাদের এমন একটি ব্যবসায়ের কথা বলে দেব না- যা তোমাদেরকে মর্মান্তিক আযাব হ’তে মুক্তি দেবে? তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান আনবে এবং তোমাদের মাল ও জান দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম পথ, যদি তোমরা বুঝ’ (ছফ ৬১/১০-১১)।
আল্লাহ্কে খুশী করার জন্য কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে মুমিনের সকল প্রচেষ্টা নিয়োজিত করাকে শরী‘আতের পরিভাষায় ‘জিহাদ’ বলে। অন্য অর্থে স্বীয় নফসের বিরুদ্ধে, শয়তানের বিরুদ্ধে এবং মুশরিক-মুনাফিক ও ফাসেকদের বিরুদ্ধে জান-মাল ও যবান দিয়ে লড়াই করাকে ‘জিহাদ’ বলে। আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِيْنَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيْرُ- (التوبة 73) –
‘হে নবী! আপনি জিহাদ করুন কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে এবং তাদের উপরে কঠোর হৌন। তাদের ঠিকানা জাহান্নাম। সেটা কতই না মন্দ ঠিকানা’ (তাওবাহ ৯/৭৩, তাহরীম ৬৬/৯)।
জিহাদের চারটি প্রকার রয়েছে। (১) নফসের সাথে জিহাদ, (২) শয়তানের সাথে জিহাদ, (৩) কাফের ও মুনাফেকদের সাথে জিহাদ এবং (৪) জালেম, গুনাহগার ও বিদআতীদের সাথে জিহাদ।
(১) নফসের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রক্রিয়া : নফ্স কলুষিত হয় ও আখেরাতের চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে নেয় এমন সব বস্ত্তবাদী সাহিত্য, পত্র-পত্রিকা, প্রচার মাধ্যম, আলোচনা মজলিস, ক্লাব, সমিতি, দল ও সংগঠন প্রভৃতি হ’তে এবং ইসলামের নামে সকল শিরকী ও বিদ‘আতপন্থী সংগঠন হ’তে নিজেকে দূরে রাখতে হবে এবং দৈনিক দেহের খোরাক জোগানোর ন্যায় রূহের ঈমানী খোরাক জোগাতে হবে। সর্বদা দ্বীনী আলোচনা, দ্বীনী আমল ও প্রশিক্ষণ এবং দ্বীনী পরিবেশের মধ্যে উঠাবসার মাধ্যমে রূহকে তাযা রাখতে হবে। আল্লাহ বলেন,
وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُوْنَ وَجْهَهُ وَلاَ تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيْدُ زِيْنَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلاَ تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا – (الكهف 28)-
‘(হে নবী!) আপনি নিজেকে ঐসব লোকদের সঙ্গে ধৈর্যের সাথে ধরে রাখুন, যারা ডাকে তাদের প্রভুকে সকালে ও সন্ধ্যায়; তারা কামনা করে কেবলমাত্র আল্লাহর চেহারা। আপনি তাদের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবেন না। আপনি কি দুনিয়াবী জীবনের জৌলুস চান? আপনি ঐ ব্যক্তির অনুসরণ করবেন না যার অন্তর আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল হয়েছে এবং সে প্রবৃত্তির অনুসারী হয়েছে ও তার কাজকর্মে সীমালংঘন এসে গিয়েছে’ (কাহ্ফ ১৮/২৮)।
(২) শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রক্রিয়া : আল্লাহ বা তাঁর প্রেরিত শরী‘আতের কোন বিধান সম্পর্কে মনের মধ্যে যখনই কোন সন্দেহ উঁকি মারবে, তখনই তাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। যেমন (১) ইসলামের বিধান সমূহ এযুগে অচল (২) ইসলামী শরী‘আতের চাইতে মানব রচিত বিধান সমূহ অনেক উন্নত ও কল্যাণময় (৩) হাদীছ সন্দেহযুক্ত, কুরআনই যথেষ্ট (৪) হাদীছে কোন ছহীহ-যঈফ নেই, সব হাদীছই সঠিক (৫) ইমাম-মাযহাব বা পীর মানাই যথেষ্ট, হাদীছ মানার প্রয়োজন নেই ইত্যাকার শয়তানী ধোঁকা সমূহ। নিজের ঘরের জানালা পথে চোর উঁকি মারলে যেমন আমরা তার পিছু ধাওয়া করি, তেমনি মনের জানালা পথে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের কোন আদেশ বা নিষেধের কার্যকারিতা সম্পর্কে কোনরূপ সন্দেহবাদ উঁকি-ঝুঁকি মারলে তাকেও প্রথম আঘাতে দূরে নিক্ষেপ করতে হবে। অহেতুক সন্দেহ ও যুক্তিবাদের ধূম্রজাল সৃষ্টিকারী অতি বুদ্ধিমানদের কাছ থেকে এবং বে-দলীল অন্ধ অনুসারীদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। আল্লাহ বলেন,
وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِيْنَ يَخُوضُوْنَ فِيْ آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوضُوْا فِي حَدِيْثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنْسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلاَ تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِيْنَ- (الأنعام 68)-
‘যখন তুমি লোকদের দেখবে যে, তারা আমার আয়াত নিয়ে উপহাস মূলক আলোচনায় লিপ্ত হয়েছে, তখন দূরে সরে থাকবে, যে পর্যন্ত না তারা অন্য আলোচনায় লিপ্ত হয়। (তাদের যুক্তিবাদের ফলে) যদি শয়তান তোমাকে ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণ হওয়ার পরেই তুমি আর সীমা লংঘনকারীদের সাথে বসো না’ (আন‘আম ৬/৬৮)।
(৩ ও ৪) কাফির, মুশরিক, মুনাফিক ও ফাসিকদের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রক্রিয়া : হাত দ্বারা, জান দ্বারা, মাল দ্বারা ও অন্তর দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে ঘরে-বাইরে সর্বত্র ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। যাবতীয় শিরক, বিদ‘আত ও ফিস্ক্ব-ফুজূরীর বিরুদ্ধে মুমিনের গৃহকে লৌহ কঠিন দূর্গ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। মুমিনের চিন্তা-চেতনা, কথা ও কলম, আয় ও উপার্জন সবকিছুই সর্বদা নিয়োজিত থাকবে বাতিলের বিরুদ্ধে আপোষহীন যোদ্ধার মত। প্রত্যেক গ্রামে ও মহল্লায় আল্লাহর সেনাবাহিনী হিসাবে বয়স্ক ও তরুণদের একটি জামা‘আতকে সংগঠিত হ’তে হবে, যারা আমীরের নির্দেশনা মোতাবেক পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী নিজেদের জীবন, পরিবার ও সমাজ গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবেন ও সমাজ সংস্কারে ব্রতী হবেন। হক্বপন্থী এই লোকদের সংখ্যা কোন স্থানে যদি তিনজনও থাকেন, তবুও তাদেরকে একজন আমীরের অধীনে জামা‘আতবদ্ধ হ’তে হবে ও ইসলামী অনুশাসন মোতাবেক জীবন যাপন করতে হবে। তথাপি তবাগূতী শক্তির নিকটে যাওয়া যাবে না বা বিশৃংখল জীবন যাপনও করা চলবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ يَحِلُّ لِثَلاَثَةِ نَفَرٍ يَكُوْنُوْنَ بِأَرْضِ فَلاَةٍ إِلاَّ أُمِّرُوْا عَلَيْهِمْ أَحَدَهُمْ، رواه أحمد وأبو داؤد-
‘তিন জন লোকের জন্যও হালাল নয় কোন নির্জন ভূমিতে অবস্থান করা তাদের মধ্যে একজনকে আমীর নিয়োগ না করা পর্যন্ত’।[1]
আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا أَطِيعُوْا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ، فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلىَ اللهِ وَالرَّسُوْلِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ، ذٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيْلاً- (النساء 59)-
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের মধ্যকার আমীরের। অতঃপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদ কর, তাহ’লে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও বিচার দিবসের উপরে বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম’ (নিসা ৪/৫৯)।
অত্র আয়াতে রাসূলের আনুগত্যের সাথে আমীরের আনুগত্যকে যুক্ত করা হয়েছে। কেননা রাসূলের মৃত্যুর পরে ক্বিয়ামত পর্যন্ত রাসূলের রেখে যাওয়া দ্বীন বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব থাকবে ‘আমীর’দের উপরে। তবে আমীরের আনুগত্য আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের শর্তাধীন। এ আয়াতে বুঝা যায়, ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম থাক বা না থাক মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে সর্বাবস্থায় ‘আমীর’ থাকা যরূরী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
وَعَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ ….. وَمَنْ مَاتَ وَلَيْسَ فِىْ عُنُقِهِ بَيْعَةٌ مَاتَ مِيْتَةً جَاهِلِيَّةً- رواه مسلم-
‘যে ব্যক্তি মারা গেল অথচ তার গর্দানে আমীরের আনুগত্যের বায়‘আত থাকল না, সে জাহেলী হালতে মৃত্যুবরণ করল’।[2]
সকল প্রকার মা‘রূফ বা শরী‘আত অনুমোদিত বিষয়ে আমীরের নির্দেশ পালন করা মামূরের জন্য ফরয। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ …..وَمَنْ يُّطِعِ الأَمِيْرَ فَقَدْ أَطَاعَنِىْ وَمَنْ يَّعْصِ الأَمِيْرَ فَقَدْ عَصَانِىْ- متفق عليه-
অর্থ : ‘এবং যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য করল সে আমার আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি আমীরের অবাধ্যতা করল সে আমার অবাধ্যতা করল’।[3]
অন্যত্র আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তার উম্মতকে জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন, আমীরের আদেশ শ্রবণসহ ৫টি আদেশ প্রদান করেছেন।[4] তিনি বলেন, يَدُ اللهِ عَلَي الْجَمَاعَةِ ‘জামা‘আতের উপর আল্লাহর হাত থাকে’।[5]
সম্ভবতঃ এত কড়া হুকুমের কারণেই ছাহাবায়ে কেরাম রাসূলের মৃত্যুর পর তাঁর দাফন কার্যের পূর্বেই ‘আমীর’ নিয়োগের প্রতি এত অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং যে জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর দাফন কার্য তিনদিন বিলম্বিত হয়। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত থাকলে তার নির্বাচিত আমীরের নিকটে বায়‘আত না করলে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করতে হবে। এতদ্ব্যতীত ধর্মীয় উন্নতি ও অগ্রগতির সকল কাজে যোগ্য আমীরের অধীনে জামা‘আত গঠন করে ইসলামী বা অনৈসলামী সমাজ বা রাষ্ট্রের মধ্যে ইসলামী দাওয়াত পরিচালনার অপরিহার্যতা বুঝানো হয়েছে বাকী হাদীছগুলিতে।
উপরোক্ত হাদীছ সমূহে মুসলিম উম্মাহকে কুরআন ও সুন্নাহর অনুশাসন মোতাবেক সুশৃংখলভাবে সামাজিক জীবন পরিচালনার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
আমরা বিশ্বাস করি যে, প্রতিটি গ্রাম বা মহল্লায় যখন একদল সৎসাহসী মুজাহিদ তরুণ আল্লাহকে রাযী-খুশী করার জন্য ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হবেন এবং সমাজের সকল কল্যাণ কর্মে নিজেদেরকে নিয়োজিত করবেন, তখন সংখ্যায় যত কমই হৌক না কেন আল্লাহর সাহায্য নিয়ে তারাই জয়লাভ করবেন।
বস্ত্ততঃপক্ষে এটাই হ’ল ‘জিহাদ’। আর এর মাধ্যমেই আসে কাংখিত ‘সমাজ বিপ্লব’।
সমাজে চিরকাল বাতিলপন্থীর সংখ্যা বেশী ছিল, আজও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই অধিকাংশ বাতিলের ভোট নিয়ে হক প্রতিষ্ঠা করা বিলাসী কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। নবীগণ কখনোই এপথে যাননি। তাঁদের পথ ছিল দাওয়াত ও জিহাদের পথ, নছীহত ও প্রতিরোধের পথ। নবীগণ সমাজের সংখ্যালঘু হকপন্থীদের খুঁজে বের করে তাদেরকে আল্লাহর নামে সংঘবদ্ধ করেছিলেন। তাঁদের মাধ্যমেই এসেছিল সমাজের আমূল পরিবর্তন। আজও সেই পথ ধরে এগোতে হবে; অন্যদের শিখানো পথ ধরে নয়।
আধুনিক রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক প্রশাসন যদি কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিরোধী হয়, তবে তা একটি ত্বাগূত ছাড়া কিছুই নয়। মুমিন কখনোই ত্বাগূত দ্বারা শাসিত হ’তে পারে না। সে কোন অবস্থাতেই ত্বাগূতের নিকটে তার বিচার-ফায়ছালার দায়িত্ব অর্পণ করতে পারে না (নিসা ৪/৬০,৬৫)। ঐ ত্বাগূতী সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য মুমিনকে তাই সর্বদা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। এজন্য তাকে সর্বদা রাসূলের দেখানো পথে চলতে হয়। কিন্তু এ পথে কাফির-মুশরিকদের চেয়ে মুনাফিকরাই সবচেয়ে বড় বাধা। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَإِذَا قِيْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلىٰ مَا أَنْزَلَ اللهُ وَإِلىَ الرَّسُوْلِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِيْنَ يَصُدُّوْنَ عَنْكَ صُدُوْدًا- (النساء 61)-
‘যখন তাদেরকে বলা হয় আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে তোমরা ফিরে এসো, তখন আপনি মুনাফিকদের দেখবেন যে তারা আপনার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে (অর্থাৎ তারাই প্রথমে পথরোধ করে দাঁড়াবে)’ (নিসা ৪/৬১)।
বলা বাহুল্য এই রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অপশক্তির বিরুদ্ধে উত্থান করতে গিয়েই উপমহাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভী (১২০১-১২৪৬হিঃ/১৭৮৬-১৮৩১খৃঃ) ও আল্লামা ইসমাঈল শহীদের (১১৯৩-১২৪৬হিঃ/১৭৭৯-১৮৩১খৃঃ) আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘জিহাদ আন্দোলন’, মাওলানা সৈয়দ নিছার আলী তীতুমীরের (১১৯৭-১২৪৬হিঃ/১৭৮২-১৮৩১খৃঃ) ‘মোহাম্মাদী আন্দোলন’, হাজী শরী‘আতুল্লাহর (১১৯৬-১২৫৬হিঃ/১৭৮১-১৮৪০খৃঃ) ‘ফারায়েযী আন্দোলন’ প্রভৃতি। সমস্ত দেশকে বা সমস্ত মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার দুঃস্বপ্ন তাঁরা দেখেননি কিংবা প্রতিষ্ঠিত বাতিল শক্তিকে উৎখাত করতে পারবেন এ অবাস্তব চিন্তাও তাঁরা করেননি। দুনিয়াবী নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব লাভের মোহও তাঁদের ছিল না। বরং যে কয়জন আল্লাহর পাগল নিবেদিত প্রাণ ভাইকে তাঁরা সাথে পেয়েছিলেন, সেই কয়জন মর্দে মুজাহিদকে নিয়ে তাঁরা স্বীয় যুগের ত্বাগূতী শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। তাঁরা ‘আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকার’-এর দায়িত্ব পালন করেছিলেন মাত্র। ফলাফল আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। আজও আমরা সেটাই চাই।
আমাদের হৃদয়ের কান্না হ’ল এদেশে ইসলাম তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাক। বাংলার ব্যক্তি ও সমাজ জীবন পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে গড়ে উঠুক। যালেম নিরত হৌক, মযলূমের মুখে অনাবিল হাসি ফুটে উঠুক। আসুন! আমরা আমাদের ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী গড়ে তুলি। সমাজের অন্যান্য ভাইকে নিরন্তর দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনি এবং যেখানেই থাকি জীবনের সর্বক্ষেত্রে কিতাব ও সুন্নাতের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর নামে জান ও মাল দিয়ে সর্বাত্মক জিহাদে অবতীর্ণ হই। আল্লাহ বলেন,
انْفِرُوْا خِفَافًا وَّثِقَالاً وَجَاهِدُوْا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ- (التوبة 41)-
‘তোমরা তরুণ ও বৃদ্ধ সকল অবস্থায় বেরিয়ে পড় এবং তোমাদের মাল ও জান দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম পন্থা, যদি তোমরা বুঝ’ (তাওবাহ ৯/৪১)। এই আয়াত পাঠ করে ছাহাবী আবু ত্বালহা (রাঃ) তাঁর ছেলেদেরকে বললেন, আমাকে জিহাদে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। যুবক ছেলেরা বলল- আপনি আল্লাহর রাসূলের সাথে, তারপর আবুবকরের সাথে, তারপর ওমরের যুগে তাঁর সাথে জিহাদে গিয়েছেন। এখন তাঁরা সবাই মৃত। আপনি নিরত হৌন, আমরাই আপনার পক্ষ হ’তে যুদ্ধে যাব। পিতা আবু ত্বালহা ছেলেদের এই প্রস্তাব অস্বীকার করলেন। অতঃপর তিনি যুদ্ধে গিয়ে মারা গেলেন। সাগরে নয় দিন লাশ ভাসতে ভাসতে অবশেষে এক দ্বীপে গিয়ে ঠেকলে সাথীরা তাকে সেখানেই দাফন করলেন।[6]
আললাহ বলেন,
لاَ يَسْتَوِي الْقَاعِدُوْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ غَيْرُ أُولِي الضَّرَرِ وَالْمُجَاهِدُوْنَ فِي سَبِيْلِ اللهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ، فَضَّلَ اللهُ الْمُجَاهِدِيْنَ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ عَلَى الْقَاعِدِيْنَ دَرَجَةً، وَكُلاَّ وَعَدَ اللهُ الْحُسْنَى وَفَضَّلَ اللهُ الْمُجَاهِدِيْنَ عَلَى الْقَاعِدِيْنَ أَجْرًا عَظِيْمًا- (النساء 95)-
‘অক্ষম ব্যতীত গৃহে উপবিষ্ট মুমিনগণ সমান নয় ঐসব মুজাহিদগণের, যারা তাদের মাল ও জান নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে। আল্লাহ মুজাহিদগণের সম্মান ঐসব উপবিষ্টদের উপরে বৃদ্ধি করেছেন এবং প্রত্যেকের সাথেই আল্লাহ কল্যাণের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহ উপবিষ্টদের উপরে মুজাহিদগণকে মহান প্রতিদানে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন’ (নিসা ৪/৯৫)। অর্থাৎ জিহাদে যেতে আগ্রহী অক্ষম উপবিষ্টগণ যেমন অন্ধ, খঞ্জ, রোগী প্রভৃতি এবং জিহাদে গমন কারীগণ উভয়ের সাথেই কল্যাণের ওয়াদা রয়েছে।
আল্লাহর চূড়ান্ত ঘোষণা শ্রবণ করুন,
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللهُ الَّذِيْنَ جَاهَدُوْا مِنْكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِيْنَ- (آل عمران 142)-
‘তোমরা কি ভেবেছ জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ আল্লাহ এখনও প্রমাণ জানতে পারেননি, কে তোমাদের মধ্যে সত্যিকারের মুজাহিদ ও কে সত্যিকারের দৃঢ়চিত্ত?’ (আলে ইমরান ৩/১৪২)।[7]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, কোন্ জিহাদ সর্বোত্তম? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে তার মাল ও জান দ্বারা’।[8]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
وَعَنْ أَنَسٍ عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : جَاهِدُوا الْمُشْرِكِيْنَ بِأَمْوَالِكُمْ وَ أَنْفُسِكُمْ وَ أَلْسِنَتِكُمْ، رواه أبوداؤد والنسائى والدارمى بإسناد صحيح-
‘তোমরা জিহাদ কর মুশরিকদের বিরুদ্ধে তোমাদের মাল দ্বারা, জান দ্বারা ও যবান দ্বারা’ (‘যবান’ অর্থ কথা ও কলম)।[9]
তিনি আরো এরশাদ করেন,
وَعَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : مَنْ مَّاتَ وَ لَمْ يَغْزُ وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِّنْ نِفَاقٍ، رواه مسلم-
‘যে ব্যক্তি মারা গেল অথচ জিহাদ করল না কিংবা অন্তরের মধ্যে কখনও জিহাদের কথাও আনলো না; সে এক ধরনের মুনাফেকীর হালতে মৃত্যু বরণ করল’।[10]
তিনি এরশাদ করেন,
وَعَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِّنْ أُمَّتِىْ يُقَاتِلُوْنَ عَلى الْحَقِّ ظَاهِرِيْنَ عَلى مَنْ نَاوَأَهُمْ حَتَّى يُقَاتِلَ آخِرُهُمُ الْمَسِيْحَ الدَّجَّالَ، رواه أبوداؤد-
‘আমার উম্মতের মধ্যে একটা দল থাকবে যারা হক-এর পথে সংগ্রাম করবে। তারা শত্রু পক্ষের উপরে জয়লাভ করবে। তাদের সর্বশেষ দলটি দাজ্জালের সঙ্গে লড়াই করবে’।[11]
আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সেই হকপন্থী মুজাহিদ দলটির অন্তর্ভুক্ত করুন এবং আমাদেরকে সর্বদা দাওয়াত ও জিহাদের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করার তাওফীক দান করুন- আমীন ইয়া রববাল ‘আলামীন।
১৪. আহমাদ, আবুদাঊদ, ছহীহ জামে‘ ছাগীর -আলবানী হা/৫০০; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/৯৬০।
১৫. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৬৭৪ ‘নেতৃত্ব ও বিচার’ অধ্যায়।
১৬. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৬৬১।
১৭. তিরমিযী, মিশকাত হা/৩৬৯৪ হারেছ আল-আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে সনদ ছহীহ।
১৮. তিরমিযী, মিশকাত হা/১৭৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৮০৬৫।
১৯. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা তওবা ৪১।
২০. একই মর্মে তাওবাহ ১৬, মুহাম্মাদ ৩১।
২১. আবুদাঊদ, সনদ ছহীহ, মিশকাত-আলবানী হা/৩৮৩৩ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
২২. আবুদাঊদ, নাসাঈ, সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৩৮২১।
২৩. মুসলিম, মিশকাত হা/৩৮১৩ ‘জিহাদ’ অধ্যায়।
২৪. আবুদাউদ, সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৩৮১৯।