রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৫:০১ পূর্বাহ্ন

খারেজী সম্প্রদায়ঃ পরিচয়, উৎপত্তি ও চিন্তাধারা।
রিপোর্টারের নাম / ৩২০১ কত বার
আপডেট: শনিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২১

▌খারেজী সম্প্রদায়ঃ পরিচয়, উৎপত্তি ও চিন্তাধারা।
━━━━━━━━━━━━━━━━
ইসলামের ইতিহাসে সন্ত্রাসী গ্রুপের উত্থানের প্রথম ঘটনা আমরা দেখতে পাই খারিজী সম্প্রদায়ের কর্মকাণ্ড। ৩৫ হিজরী সালে (৬৫৬ খু.) ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান উসমান ইবনু আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহু কতিপয় বিদ্রোহীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। এরপর আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মুসলিম রাষ্ট্রের সেনাপতি ও গভর্নরগণ আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর আনুগত্য স্বীকার করেন। কিন্তু সিরিয়ার গভর্নর মু’আবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু আলীর আনুগত্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। তিনি দাবি জানান যে, আগে খলীফা উসমানের হত্যাকারীদের বিচার করতে হবে। আলী দাবি জানান যে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পূর্বে বিদ্রোহীদের বিচার শুরু করলে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পেতে পারে, কাজেই আগে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ক্রমান্বয়ে বিষয়টি জোরালাে হয়ে গৃহ যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। সিফফীনের যুদ্ধে উভয়পক্ষে হতাহত হতে থাকে। এক পর্যায়ে উভয়পক্ষ আলােচনার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য একটি সালিশী মজলিস গঠন করেন। এই পর্যায়ে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর অনুসারীগণের মধ্য থেকে কয়েক হাজার মানুষ আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর পক্ষ ত্যাগ করেন। এদেরকে ‘খারিজী দলত্যাগী বা বিদ্রোহী বলা হয়। এরা ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় প্রজন্মের মানুষ, যারা রাসূলুল্লাহর ইন্তেকালের পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। এদের প্রায় সকলেই ছিলেন যুবক। এরা ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক, সৎ ও নিষ্ঠাবান আবেগী মুসলিম। এরা দাবি করেন যে, একমাত্র কুরআনের আইন ও আল্লাহর হুকুম ছাড়া কিছুই চলবে না।

আল্লাহর বিধান অবাধ্যদের সাথে লড়তে হবে। আল্লাহ বলেছেন:

وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا ۖ فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيءَ إِلَىٰ أَمْرِ اللَّهِ ۚ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا ۖ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ

“মুমিনগণের দুই দল যুদ্ধে লিপ্ত হলে তােমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে। অতঃপর তাদের একদল অপর দলের উপর অত্যাচার বা সীমালঙ্ন করলে তােমরা জুলুমকারী দলের সাথে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে”। 🔹সূরা আল-হুজুরাত: ৯

এছাড়া কুরআনুল কারীমে এরশাদ করা হয়েছে:
إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ ۖ
কর্তৃত্ব শুধুমাত্র আল্লাহরই বা “বিধান শুধু আল্লাহরই। 🔹সূরা আল-আনআম: ৫৭

কাজেই মানুষকে ফয়সালা করার দায়িত্ব প্রদান কুরআনের নির্দেশের স্পষ্ট লঙ্ঘন। কুরআনুল কারীমে আরাে এরশাদ করা হয়েছে,

ومن لم يخ بما أنزل الله فأولية هم الكافرون ۞

“আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদানুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই কাফির”। 🔹সূরা আল-মায়িদাহ: ৪৪

তারা কুরআনের এসব নির্দেশনার অপব্যাখ্যা করে। আলী ও তার অনুগামীগণ যেহেতু আল্লাহর নাযিল করা বিধান মত মু’আবিয়ার সাথে যুদ্ধ না চালিয়ে, সালিশের বিধান দিয়েছেন, সেহেতু তাঁরা কাফির।

তারা দাবি করেন, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু, মু’আবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু ও তাঁদের অনুসারীগণ সকলেই কুরআনের আইন অমান্য করে কাফির হয়ে গিয়েছেন। কাজেই তাদের তাওবা করতে হবে। তাঁরা তাঁদের কর্মকে অপরাধ বলে মানতে অস্বীকার করলে তারা তাঁদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে।

তাঁরা তাঁদের মতের পক্ষে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত উদ্ধৃত করতে থাকেন। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য সাহাবী তাদেরকে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, কুরআন ও হাদীস বুঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে পারঙ্গম হলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আজীবনের সহচর সাহাবীগণ। কুরআন ও হাদীসের তােমরা যে অর্থ বুঝেছ তা সঠিক নয়, বরং সাহাবীদের ব্যাখ্যাই সঠিক। এতে কিছু মানুষ উগ্রতা ত্যাগ করলেও বাকিরা তাদের মতকেই সঠিক বলে দাবি করেন।

এরা ইসলাম ও মুসলিম সম্পর্কে ‘পিউরিটান’ ধারণা লালন করত। তারা মনে করত যে, ইসলামী বিধিবিধানের লংঘন হলেই মুসলিম ব্যক্তি কাফিরে পরিণত হয়। এজন্য তারা এইরূপ কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা রাজনৈতিক পর্যায়ে ইসলামী বিধিবিধান পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের বাইরে দলবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করে। পাশাপশি এই মহান উদ্দেশ্যে (!) যুদ্ধের ময়দান ছাড়া অন্যত্র গুপ্ত হত্যা করে। এছাড়া তারা আলীকে কাফির মনে করেন না এরূপ সাধারণ অযােদ্ধা পুরুষ, নারী ও শিশুদের হত্যা করতে থাকে।

▌খারিজীদের ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ভবিষ্যদ্বাণীঃ
━━━━━━━━━━━━━━━━
আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ

بَاب إِثْمُ مَنْ رَاءَى بِقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ أَوْ تَأَكَّلَ بِهِ أَوْ فَخَرَ بِهِ. عَبْدُ اللهِ بْنُ يُوْسُفَ أَخْبَرَنَا مَالِكٌ عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيْدٍ عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِبْرَاهِيْمَ بْنِ الْحَارِثِ التَّيْمِيِّ عَنْ أَبِيْ سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ أَنَّهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ يَخْرُجُ فِيْكُمْ قَوْمٌ تَحْقِرُوْنَ صَلَاتَكُمْ مَعَ صَلَاتِهِمْ وَصِيَامَكُمْ مَعَ صِيَامِهِمْ وَعَمَلَكُمْ مَعَ عَمَلِهِمْ وَيَقْرَءُوْنَ الْقُرْآنَ لَا يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ يَمْرُقُوْنَ مِنْ الدِّيْنِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنْ الرَّمِيَّةِ يَنْظُرُ فِي النَّصْلِ فَلَا يَرَى شَيْئًا وَيَنْظُرُ فِي الْقِدْحِ فَلَا يَرَى شَيْئًا وَيَنْظُرُ فِي الرِّيْشِ فَلَا يَرَى شَيْئًا وَيَتَمَارَى فِي الْفُوْقِ.

ভবিষ্যতে এমন সব লোকের আগমন ঘটবে, যাদের সালাতের তুলনায় তোমাদের সালাতকে, তাদের সওমের তুলনায় তোমাদের সওমকে এবং তাদের ‘আমালের তুলনায় তোমাদের ‘আমালকে তুচ্ছ মনে করবে। তারা কুরআন পাঠ করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালীর নিচে (অর্থাৎ অন্তরে) প্রবেশ করবে না। এরা দ্বীন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেমনভাবে নিক্ষিপ্ত তীর ধনুক থেকে বেরিয়ে যায়। আর শিকারী সেই তীরের আগা পরীক্ষা করে দেখতে পায়, তাতে কোন চিহ্ন নেই। সে তীরের ফলার পার্শ্বদেশে নযর করে; অথচ সেখানে কিছু দেখতে পায় না। শেষে ঐ ব্যক্তি কোন কিছু পাওয়ার জন্য তীরের নিম্নভাগে সন্দেহ পোষণ করে। 🔹 সহীহ আল-বুখারীঃ ৫০৫৮

এদের পরিচয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে দিয়েছেন, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বিভিন্ন সহীহ সনদে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

يأتي في آخر الزمان قوم حدثاء الأسنان سفهاء الأحلام يقولون من خير قول البرية يمرقون من الإسلام كما يمرق السهم من الرمية لا يجاوز إيمانهم حنجرهم، فإذا لقيتموهم فاقتلوهم فإن في قتلهم أجرا لمن قتلهم عند الله يوم القيامة

“শেষ যুগে এমন একটি সম্প্রদায় আগমন করবে যারা বয়সে তরুণ এবং তাদের বুদ্ধিজ্ঞান অপরিপক্কতা, বােকামি ও প্রগলভতায় পূর্ণ। মানুষ যত কথা বলে তন্মধ্যে সর্বোত্তম কথা তারা বলবে। কিন্তু তারা ইসলাম থেকে তেমনি ছিটকে বেরিয়ে যাবে, যেমন করে তীর শিকারের দেহ ভেদ করে ছিটকে বেরিয়ে যায়। তাদের ঈমান তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তােমরা যখন তাদেরকে পাবে তখন তাদেরকে হত্যা করবে। কারণ তাদেরকে যারা হত্যা করবে তাদের জন্য কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকট পুরস্কার থাকবে”।

এখানে ইসলামের নামে বা সত্য, ন্যায় ও হক্ক প্রতিষ্ঠার নামে সন্ত্রাসী কর্মে লিপ্ত মানুষদের দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে:

প্রথমত, এরা অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সের। এদের নেতৃত্ব, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ইত্যাদি সবই যুবক বা তরুণদের হাতে। সমাজের বয়স্ক ও অভিজ্ঞ আলিম ও নেতৃবৃন্দের নেতৃত্ব বা পরামর্শ এরা মূল্যায়ন করে না।

দ্বিতীয়ত, এদের বুদ্ধি অপরিপক্ক ও প্রগলভতাপূর্ণ। আমরা আগেই দেখেছি যে, সকল সন্ত্রাসই মূলত রাজনৈতিক পরিবর্তন অর্জনের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। আর রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য অস্থিরতা ও অদুরদর্শিতা সন্ত্রাসী কর্মের অন্যতম কারণ। অপরিপক্ক বুদ্ধি, অভিজ্ঞতার অভাব ও দূরদর্শিতার কমতির সাথে নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধির অহঙ্কার এ সকল সত্যান্বেষী ও ধার্মিক যুবককে ইসলাম থেকে বিচ্যুত করেছিল।

▌খারিজী সম্প্রদায়ের বিভ্রান্তির কারণঃ
━━━━━━━━━━━━━━━━
১. জ্ঞানের অহঙ্কার :

ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের এই ঘটনা পর্যালােচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, জ্ঞানের অহঙ্কারই ছিল তাদের বিভ্রান্তির উৎস। আমরা এরূপ উগ্রতা ও সন্ত্রাসে লিপ্তদের দুটি বৈশিষ্টের দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ কথা উল্লেখ করেছেন: তারুণ্য এবং বুদ্ধির অপরিপক্কতা বা হটকারিতা। এ কারণে তারা ইসলাম বুঝার ক্ষেত্রে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজেদের বুঝকেই -এর আজীবনের সহচর ও দীন সম্পর্কে অধিক চূড়ান্ত মনে করত। রাসূলুল্লাহর জ্ঞানী সাহাবীগণের মতামতকে অবজ্ঞা করা বা তাদের পরামর্শ গ্রহণকে তারা অপ্রয়ােজনীয় বলে মনে করত। তাদের বুঝের বাইরে মত-প্রকাশ’কারীদের-কে ঢালাওভাবে তারা অবজ্ঞা করত। এমনকি কাফির আখ্যায়িত করত।

উপর্যুক্ত বিভ্রান্তি থেকে তারা বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, যেগুলির কারণে তারা তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জিহাদ বলে মনে করে।

২. মুসলিমদেরকে বিভিন্ন অজুহাতে কাফির আখ্যা দেয়া

খারিজীদের বিদ্রোহ, উৎপত্তি ও বিকাশের প্রথম সূত্র ছিল, কুরআনুল কারীমের কিছু আয়াতের আলােকে আল্লাহর বিধানমত ফয়সালা না দেওয়া কুফুরি কাজ। এটিই ছিল খারিজীদের প্রথম মূলনীতি। তারা কুরআনের কিছু আয়াতের বাহ্যিক অর্থের ভিত্তিতে দাবি করে যে, মুসলিম পাপে লিপ্ত হলে সে কাফির বা ঈমান হারা হয়ে যায়। তাদের মতে ইসলামের যে কোন অনুশাসন ত্যাগ করাই কুফুরি । কাজেই যে ব্যক্তি ইসলামের কোনাে অনুশাসন লঙ্ঘন করে সে ঈমানহারা বা কাফিরে পরিণত হয়।

এ ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য বিষয় হচ্ছে কুরআন হাদীসের আলােকে স্পষ্টতই পাপ। যেমন, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, মিথ্যাচার ইত্যাদি। খারিজীগণ শুধু এগুলিকেই কুফরী বলে গণ্য করেনি। উপরন্তু, তাদের মতের বিপরীত রাজনৈতিক কর্ম বা সিদ্ধান্তকে ব্যাখ্যার মাধ্যমে ‘পাপ বলে গণ্য করেছে, এরপর তারা সেই পাপকে কুফরী বলে গণ্য করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে কাফির আখ্যা দিয়েছে।

প্রকৃত পক্ষে খারিজীগণের কাফির-কথনের মূল ভিত্তি ‘পাপ নয়, বরং রাজনৈতিক মতাদর্শ তারা তাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী নয় এরূপ সকল মুসলিমকে কাফির বলে গণ্য করত।

৩. কাফিরকে ঢালাও ভাবে হত্যা করা বৈধ মনে করাঃ

কাউকে কাফির বলে গণ্য করা আর তাকে হত্যা করা কখনােই এক বিষয় নয়। কিন্তু খারিজীরা সাধারণ মুসলিমদেরকে কাফির বলেই ক্ষান্ত হয় নি, তারা তাদেরকে ঢালাওভাবে হত্যা করার বৈধতা দাবি করেছে।

৪. রাষ্ট্রীয় আনুগত্য ও ইমাম সম্পর্কে তাদের ভুল ধারণাঃ

রাষ্ট্রের আনুগত্যের বাইরে যাওয়া কত বড় অপরাধ তা তারা কোন ভাবেই বুঝার চেষ্টা করত না; বরং তারা রাষ্ট্রদ্রোহীতাকে কখনাে কখনাে বৈধ কাজ মনে করত। খারিজীগণ রাষ্ট্র, রাষ্ট্রপ্রধান ইত্যাদির কোনাে গুরুত্ব স্বীকার করত না। পরবর্তীতে কেউ কেউ তাদেরকে রাষ্ট্র, ইমাম, বাইয়াত ইত্যাদির গুরুত্বের বিষয়ে বললে তারা তাদের মধ্য থেকে একজনকে ‘আমীর বা ইমাম বলে বাইয়াত করে নেয়। এভাবে তারা রাষ্ট্রীয় পরিভাষাগুলিকে ‘দলের ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করে। ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের ব্যাপারে তাদের মধ্যে বিভিন্ন নতুন চিন্তাধারা সৃষ্টি হয়।

৫. জিহাদকে ব্যক্তিগত ফরয বলে গণ্য করে ইচ্ছামত জিহাদ ঘােষণা করাঃ

কুরআন-হাদীসে অগণিত স্থানে জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং জিহাদের জন্য মহান পুরস্কার ঘােষণা করা হয়েছে। কাফিরদের সাথে যুদ্ধ ছাড়াও মুসলিম-অমুসলিম সকলের মধ্যে সৎকাজে আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভ্রান্তির ফলে খারিজীগণ রাষ্ট্রীয় ফরয ও ব্যক্তিগত ফযের মধ্যে কোনাে পার্থক্য করত না। তারা জিহাদ ও ‘আদেশ নিষেধ বিষয়ক কুরআনী নির্দেশনার আলােকে প্রচার করে যে, জিহাদ ও আদেশ-নিষেধ ইসলামের রুকন ও ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয।

(এ প্রবন্ধটি প্রফেসর ড. খােন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)-এর লেখ “ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ” গ্রন্থ থেকে সংকলিত ও সম্পাদক কর্তৃক পরিমার্জিত ও সম্পাদিত।)

▌খারেজীদের কিছু বৈশিষ্ট্য ও আলামত
━━━━━━━━━━━━━━━━
❑ তারা হবে নবীন, তরুণ ও নির্বোধ, অথচ নিজেদেরকে অনেক জ্ঞানী ভাববে।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ৩৬১১, ৫০৫৭, ৬৯৩৪; মুসলিম হা/ ২৪৬২, ২৪৬৯ ]

❑ তারা সর্বোত্তম (অর্থাৎ খুব ভালো ভালো) কথা বলবে, কিন্ত সবচেয়ে নিকৃষ্ট কাজ (অর্থাৎ নিত্যনতুন ফিত্না সৃষ্টি) করবে।
— [ সূত্রঃ মুসলিম হা/২৪৬২; আবুদাঊদ হা/৪৭৬৭; আহমাদ হা/২০৪৪৬ ]

❑ বাহ্যিকভাবে সুন্দর কথা বলবে অর্থাৎ তাদের কথাগুলো সঠিক মনে হবে।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ৫০৫৭ ]

❑ মুখে ঈমানের কথা বললেও তাদের অন্তরে ঈমানের লেশমাত্র থাকবে না।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/৩৪১৫ ]

❑ তাদের ঈমান ও ছালাত তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না।
— [ সূত্রঃ মুসলিম হা/২৪৬২ ]

❑ পথভ্রষ্ট হয়ে যাওয়ার পর এরা আর ঈমানের দিকে ফিরে আসবে না। যেমন তীর আর ধনুকের ছিলাতে ফিরে আসে না।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ২৪৬২ ]

❑ তারা হবে ইবাদতে অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী অর্থাৎ ইবাদাতে তারা আগে আগে থাকবে, কিন্তু নিজেদের ইবাদতের জন্য হবে অহংকারী। লোকেরা তাদের ইবাদত দেখে অবাক হবে।
— [ সূত্রঃ আহমাদ হা/১২৯৭২; ইবনু আবী আছিম, আস-সুন্নাহ হা/৯৪৫ ]

❑ তাদের নিদর্শন হ’ল, তাদের মাথা থাকবে ন্যাড়া।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/৩৬১০; মুসলিম হা/২৪৫১; ইবনু মাজাহ হা/১৫৭ ]

❑ তারা মুসলমানদের হত্যা করবে আর কাফের, মুশরিক ও মূর্তিপূজারীদের ছেড়ে দিবে।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ৩৬১০; মুসলিম হা/ ২৪৫১ ]

❑ তারা দ্বীনদারিতার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করবে, এমনকি দ্বীন থেকে বেরিয়ে যাবে।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ৩৬১০; মুসলিম হা/ ২৪৫১; আহমাদ হা/ ৭০৩৮; ইবনু আবী আছিম, আস-সুন্নাহ, হা/ ৯২৯-৯৩০ ]

❑ তারা মুসলিম শাসকদের নিন্দা করে, অপবাদ দেয় এবং তাদেরকে পথভ্রষ্ট ও কাফির বলে দাবী করে। যেমনটি খুওয়াইছারা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে করেছিল।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ৩৬১০; মুসলিম হা/ ১০৬৪; মিশকাত হা/ ৫৮৯৪ ]

❑ তারা মানুষকে কিতাবুল্লাহর দিকে আহবান করবে। কিন্তু সে বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞানই থাকবে না। অর্থাৎ কিতাবুল্লাহ দিয়ে দলীল গ্রহণ করবে। কিন্তু না বুঝার কারণে দলীল গ্রহণের ক্ষেত্রে ভুল করবে।
— [ সূত্রঃ আবুদাঊদ হা/ ৪৭৬৫; আহমাদ হা/ ১৩৩৩৮; মিশকাত হা/ ৩৫৪৩ ]

❑ তারা ইবাদতের ক্ষেত্রে কঠোরতা আরোপ করবে।
— [ সূত্রঃ আহমাদ হা/১২৯৭২; বায়হাক্বী, মাজমা যাওয়ায়েদ ২২৯/৬ ]

❑ তারা সর্বোত্তম দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। যেমন আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে করেছিল।
— [ সূত্রঃ আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ৭/৩০৫ ]

❑ তারা তাদের নিহতদেরকে জান্নাতী মনে করে। যেমন তারা নাহ্রাওয়ানের যুদ্ধের ময়দানে পরস্পরকে ‘জান্নাতমুখী’ ‘জান্নাতমুখী’ বলে ডাকছিল’।
— [ সূত্রঃ আল-বিদায়া ১০/৫৮৭ ]

❑ ওরা এমন জাতি যাদের অন্তরে রয়েছে বক্রতা।
— [ সূরা আলে-ইমরান ১০৬ নং আয়াতের তাফসীর, মুসনাদে আহমাদ হা/২২৩১৩ ]

❑ মতভেদ ও মতানৈক্যের সময় এদের আবির্ভাব হবে।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ৬৯৩৩ ]

❑ মক্কা থেকে পূর্বের কোন এলাকা থেকে দলটির আবির্ভাব হবে।
— [ সূত্রঃ সহীহ আল বুখারী, হা/ ৭১২৩ ]

❑ যেসব আয়াত কাফেরের জন্য প্রযোজ্য তারা সেগুলিকে মুমিনদের উপর প্রয়োগ করবে।
— [ সূত্রঃ আবুদাঊদ হা/৪৭৬৯ ]

❑ তাদের আগমন ঘটবে শেষ যামানায়।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/৩৪১৫ ]

❑ তারাও কুরআন ও সুন্নাহ দিয়েই কথা বলবে কিন্তু অপব্যাখ্যা করবে।
— [ সূত্রঃ বুখারী হা/ ৩৪১৫ ]

❑ কুরআন ও সুন্নাহ দিয়েই কথা বলবে কিন্তু অপব্যাখ্যা করবে: ফলে তারা আলেমদের সাথে সবচেয়ে বেশী শত্রুতা পোষণকারী হবে। প্রতিপক্ষের বিরোধিতা করতে গিয়ে জাল হাদীছ পর্যন্ত রচনা করে।
— [ সূত্রঃ আল-খাওয়ারিজ আক্বীদাতান ওয়া ফিকরান ৫৪-৬৮ পৃঃ ]

❑ সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের নামে এ সম্পর্কিত শরী‘আতের দলীলগুলিকে শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে থাকে।
— [ সূত্রঃ আল-খাওয়ারিজ আউয়ালুল ফিরাক্ব ফী তারীখিল ইসলাম পৃঃ ৩৭-৩৮ ও ১৪৬ ]

❑ ক্বুরআনুল কারিম থেকে তারা কেবল ভীতি প্রদর্শন সংক্রান্ত আয়াতগুলি দিয়ে দলীল গ্রহণ করে। কিন্তু ভাল কাজের পুরস্কার বা উৎসাহমূলক আয়াতগুলিকে পরিত্যাগ করে।
— [ সূত্রঃ আল-খাওয়ারিজ আউয়ালুল ফিরাক্ব ফী তারীখিল ইসলাম পৃঃ ৩৭-৩৮ ও ১৪৬ ]

❑ তারা আলেমগণকে মূল্যায়ন করবে না। নিজেদেরকেই বড় জ্ঞানী মনে করবে। যেমন খারেজীরা নিজেদেরকে হযরত আলী রাঃ, হযরত ইবনু আববাস রাঃ সহ সকল ছাহাবী (রাঃ)-এর চেয়ে জ্ঞানী দাবী করেছিল।
— [ সূত্রঃ আল-খাওয়ারিজ আউয়ালুল ফিরাক্ব ফী তারীখিল ইসলাম পৃঃ ৩৭-৩৮ ও ১৪৬ ]

❑ ওরা হুকুম লাগানোর ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করে।
— [ সূত্রঃ আল-খাওয়ারিজ আউয়ালুল ফিরাক্ব ফী তারীখিল ইসলাম পৃঃ ৩৭-৩৮ ও ১৪৬ ]

❑ তারাই সর্বপ্রথম মুসলিমদের জামা‘আত তথা আহলুস্ সুন্নাহ্ ওয়াল জামা’আত হ’তে বেরিয়ে গেছে এবং তাদেরকে পাপের কারণে কাফের সাব্যস্ত করেছে।
— [ সূত্রঃ ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২৭৯/৩৪৯, ৭/৩ ]

❑ তারা ক্বিয়াস (ধারণা বা অনুমান) ভিত্তিক কাজে বেশী বিশ্বাসী।
— [ সূত্রঃ আল-মিলাল ওয়ান-নিহাল ১১৬/১ ]

❑ তারা মনে করে যালেম শাসকের শাসন জায়েয নয়।
— [ সূত্রঃ মাকালাতুল ইসলামমিয়্যন ২০৪/১ ]

❑ ওরা মুখে আহলে ইল্মদের তথা মুহাদ্দিসিন ও ফুকাহানে ক্বিরামে ইমামগণের কথার বকওয়ায করে কিন্তু তার মর্মাথ বুঝে না।
— [ সূত্রঃ আশ-শারী‘আহ ২৮ পৃঃ ]

❑ যতবারই তাদের আবির্ভাব হবে, ততবারই তারা ধ্বংস হবে। এভাবে রাসূল (صلى الله عليه و آله و سلم) বিশ বার বলেন।
— [ সূত্রঃ ইবনু মাজাহ হা/১৭৪; আরনাঊত্ব ছহীহ বলেছেন, মুসনাদ ৩৯৮/৯ ]

❑ ভূপৃষ্ঠে সর্বদাই খারেজী আক্বীদার লোক থাকবে এবং সর্বশেষ এদের মাঝেই দাজ্জালের আবির্ভাব হবে।
— [ সূত্রঃ ইবনু মাজাহ হা/১৭৪ ]

❑ তারা হবে সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টি।
— [ সূত্রঃ মুসলিম হা/ ২৪৬৯, ২৪৫৭ ]

▌কেনো এই গোঁড়ামি ও চরমপন্থা ?
━━━━━━━━━━━━━━━━
বিভিন্ন কারণে সমাজে গৌড়ামী ও চরমপন্থার উদ্ভব হয়ে থাকে। নিয়ে গোঁড়ামী ও চরমপন্থার কয়েকটি কারণ আলােচনা করা হলােঃ

১. দ্বীনের প্রকৃত জ্ঞানের অভাবঃ

গোঁড়ামীর মৌলিক কারণগুলাের মধ্যে একটা অন্যতম কারণ হলাে দ্বীনের প্রকৃত জ্ঞানের অভাব। দ্বীনি প্রজ্ঞার স্বল্পতা, দ্বীনের রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থতা এবং তার উদ্দেশ্য-লক্ষ্য ও স্পিরিট অনুধাবনে অক্ষমতা। এসব কথার মাধ্যমে দ্বীন সম্বন্ধে পূর্ণ অজ্ঞতার কথা বুঝানাে হচ্ছে না। কারণ পূর্ণ অজ্ঞতা সম্ভবতঃ বাড়াবাড়ি ও উগ্রপন্থার দিকে নিয়ে যায় না বরং তার উল্টো দিকেই নিয়ে যায়। অর্থাৎ তা নৈতিক অবক্ষয় ও স্বেচ্ছাচারিতার দিকেই ধাবিত করে। সুতরাং প্রকৃত জ্ঞানের অভাব বলতে অপরিপক্ক জ্ঞান বুঝানাে হচ্ছে। যে ‘অপরিপক্ক জ্ঞান তাকে ‘জ্ঞানী বলে ধারণা দেয় অথচ সে অনেক কিছুই জানে না। সে এখান-সেখান হতে কিছু জ্ঞানার্জন করে-যা পরস্পর সম্পর্কহীন ও শৃঙ্খলাহীন। অর্থাৎ সে ভাসাভাসা জ্ঞানের অধিকারী হয় ঠিকই, কিন্তু জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। সে দ্বীনের একক বিষয়গুলােকে ‘মুহকামাত তথা সন্দেহহীন বিষয়গুলাের সাথে, আর অনির্ভরযােগ্য বিষয়গুলােকে নির্ভরযােগ্য বিষয়ের সাথে তুলনা করতে পারে না। সে পরস্পরবিরােধী দলিলসমূহের মধ্যে সমন্বয়সাধন ও তারজীহ তথা অগ্রাধিকার দানের কৌশল রপ্ত করতে পারে না। কোন্ দলিল অগ্রাধিকার যােগ্য আর কোন বিষয় প্রাধান্যপ্রাপ্তির যােগ্য তা উপলব্ধি করতে পারে না।🔹ড. ইউসুফ আল-কারযাভী, আল সাহওাতুল ইসলামিয়া বাইনাল জুহুদি ওয়াত তাতাররুফ, কায়রাে: দারুস সাহওয়া ১৪১২ হিজরী, পর. ৩৩-৩৬

এভাবে শরীয়তের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য না বুঝে ইচ্ছামত অভিমত গ্রহণ করে। এদের প্রতি হাদীসে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে :

عن عبد الله بن عمرو بن العاص قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول إن الله لا يقبض العلم انتزاعا ينتزعه من العباد ولكن يقبض العلم يقبض العلماء حتى إذا آش يبق عالما اخد التاش ژوسا جهالا فشلوا فأفتوا بغير علم فضلوا وأضلوا۔

“আব্দুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি- নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের নিকট থেকে ইলমকে ছিনিয়ে নিবেন না। বরং তিনি আলেমদেরকে উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে জ্ঞানকে উঠিয়ে নিবেন। ফলে কোন আলেম অবশিষ্ট থাকবেনা। তখন মানুষ অজ্ঞদেরকে নেতা বানাবে। মানুষ তাদের কাছে দ্বীনের বিষয়ে জিজ্ঞেস করবে। তখন তারা না জেনে ফতওয়া দিবে। ফলে তারা নিজেরা বিভ্রান্ত হবে এবং অন্যদেরকেও বিভ্রান্ত করবে”। 🔹সহীহ আল-বুখারী: ১০০: সহীহ মুসলিম: ৬৯৭১

মূলতঃ অহংকারযুক্ত অল্পবিদ্যা পূর্ণ অজ্ঞতার চেয়ে অত্যধিক বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর। কারণ অল্পবিদ্যার অধিকারী ব্যক্তি কম্মিনকালেও তার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেন। শুধু তাই নয়, তারা তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের দৃঢ় বিশ্বাস পােষণ করে। এ মর্মে হাফেজ ইবনু কাসীর (রহমাতুল্লাহি আলাইহি) (৭০১-৭৭৪ হিজরী,) বলেছেন :

يعتقدون يجهلهم وقلة علمهم وعقلهم ، إن هذا الأمر يرضي رب الأرض والسماوات، ولم يعلموا أنه من أكبر الكبائر الموبقات والعظائم والخطيئات وأنه مما زينه لهم إبليس الشيطان الرجيم المطرود-

তাদের অজ্ঞতা ও বিদ্যা-বুদ্ধির স্বল্পতার কারনে তারা বিশ্বাস করে যে, তাদের এ কাজে আসমান-জমিনের প্রতিপালক তুষ্ট হবেন। কিন্তু তারা জানে না যে, এটা কবীরা গুনাহসমূহের মধ্যে অধিক ধ্বংসাত্মক, মারাত্মক ও অত্যন্ত ক্ষতিকর। বহিস্কৃত ও বিতাড়িত ইবলিস এ কাজে অনুপ্রাণিত করে। 🔹ইবনু কাসীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ, কায়রো: দারুর রাইয়ান, ১৪০৮ হি/১৯৮৮ খৃ, ৭ম খণ্ড, পৃ. ২৯৭

২. দ্বীন সম্পর্কে বিকৃত ও ভুল ধারণাঃ

গোঁড়ামী ও চরমপন্থা উদ্ভবের আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে শরীয়তের বিধিবিধানসমূহ ভুল বা বেঠিকভাবে অনুধাবন করা। ইসলাম অনুধাবনের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতা, ইসলামী শরীয়ত ও রিসালাতের মূল উদ্দেশ্য অনেকের কাছে অস্পষ্ট থাকার কারণে দ্বীনের অনেক বিধান সম্পর্কে তারা বিভ্রান্তিতে পতিত হয়। এ সম্পর্কে শাইখ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ আল-বদর বলেন

ومن سوء الفهم في الدين . ما حصل للخوارج الذين خرجوا على على رضى ال له عنه و قاتلوه

فإنهم فهموا النصوص الشرعية فهما خاطئا , مخالفا لفهم الصحابة رضي الله عنهم ولهذا لما

ناظر ابن عباس فرجع من رجع منهم

‘দ্বীন সম্পর্কে ভুল ধারণা যা খারিজীরা পােষণ করতাে। যারা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর দল থেকে বের হয়ে গিয়েছিল এবং তাকে হত্যা করেছিল। তারা শরীয়তের দলিলসমূহকে ভ্রান্তভাবে বুঝতাে, যা ছিল সাহাবায়ে কিরামের বুঝের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এ কারণে ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের সাথে আলােচনা করে যখন তাদের কাছে দলিলসমূহের সঠিক বুঝ উপস্থাপন করলেন তখন তাদের মধ্যে যারা ফিরে আসার তারা ফিরে আসলাে। 🔹 আব্দুল মুহসিন ইবনু হামদ আল-আব্বাদ আল-বদর, বিআইয়ে আকলিন ওয়াদ্বীনিন ইয়াকুনুত তাফজীর ওয়াত তাদমীর জিহাদান (রিয়াদ: দারুল মুগনী লিন নাশর ওয়াত তাওযি ১ম প্রকাশ, ২০০৩/১৪২৪ হি, পৃ. ৬

৩. ইতিহাস-ঐতিহ্য, বাস্তবতা, জীবন ও বিশ্ব প্রকৃতি সম্পর্কে যথাযথ ধারণার অভাবঃ

চরমপন্থা অবলম্বনকারী ব্যক্তিগত শুধু ধর্মীয় জ্ঞানেই অপরিপক্ক নয়; ইতিহাস-ঐতিহ্য, বাস্তবতা, জীবন ও বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কে আল্লাহর সুন্নাত তথা নিয়ম সম্পর্কেও তাদের জ্ঞান অপরিপক্ক। ফলে তাদের কাউকে কাউকে দেখা যায় যে, এমনকিছু পেতে চায় যা পাওয়া সম্ভব নয়। এমন কিছু ইচ্ছা করে যা হতে পারে না। এমন অলীক কল্পনা করে যা অবাস্তব। আর বাস্তবতাকে বােঝে অপ্রকৃতভাবে এবং তারা তাদের মস্তিষ্কে বিদ্যমান ধারণামতে সব কিছুর ব্যাখ্যা দেয়। যার কোন ভিত্তি নেই আল্লাহর সৃষ্টিতে, আল্লাহর বিধানে এবং তাঁর শরীয়তের বিধি-বিধানে।

চরমপন্থী ও গোঁড়া ব্যক্তিরা গােটা সমাজ পাল্টে দিতে চায়। তারা চায় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তা-চেতনা, নিয়ম-নীতি, চরিত্র ও বিধান ইত্যাদি কাল্পনিক ও অবাস্তব নিয়ম-নীতির মাধ্যমে পরিবর্তন করে দিতে। পরিবর্তন চায় এমন দুঃসাহস, বীরত্ব ও আত্মেসর্গের মাধ্যমে যাতে মূল্যবান প্রাণের কুরবানী বেশী হয়। তারা মৃত্যুকে পরােয়া করে না। এ মৃত্যু তাদের হােক বা অন্য কারাে হােক। তারা ফলাফলের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না সেটা যা-ই হােক না কেন।

৪. বিকৃত চিন্তাধারার থেকে কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যের ব্যাখ্যাঃ

গোঁড়া ও চরমপন্থীরা কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের গভীরে প্রবেশ করে না। তারা-এর অর্থ, উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য না বুঝে আক্ষরিক ও বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করে। যেমন নিম্নোক্ত নাস-এর প্রতি লক্ষ্য করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ইমাম মালিক, বুখারী, মুসলিম ও সুনান গ্রন্থের লেখকগণ বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফিরদের দেশে ও শত্রুভূমিতে কুরআন নিয়ে সফর করতে নিষেধ করেছেন।

এ নিষেধাজ্ঞার প্রতি লক্ষ্য করলে সহজেই বুঝা যায় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন কাফিররা কুরআনের অসম্মান করবে বা তার কোন ক্ষতি করবে এ ভয়ে।

যদি কখনাে মুসলমানরা এ জাতীয় ভয় হতে মুক্ত হন তখন তারা তাদের সফরের সময় অমুসলিম দেশে নিজের সাথে আল-কুরআন নির্দ্বিধায় নিয়ে যেতে পারেন। এ বিষয়ে সমগ্র বিশ্ব আজকে একমত, কারােরই কোন দ্বিমত নেই। বরং বিভিন্ন ধর্মালম্বীরা বর্তমান যুগে তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সহজ ভাবে পৌছাবার প্রতিযােগিতায় লিপ্ত। যাতে মানুষ তাদের দ্বীন ধর্ম সম্পর্কে অবগত হতে পারে, আর তাদের ধর্মের দাওয়াত অন্যের কাছে পৌঁছে যায়। মুসলমানরাও এ পদ্ধতি অনুসরণ করার চেষ্টা করছে-যে দেশের মানুষের ভাষা আরবী নয় সেদেশের স্থানীয় ভাষায় আল-কুরআন অনুবাদ করে পৌছানোর মাধ্যমে। সুতরাং শত্রুভূমিতে কুরআন নিয়ে সফর করতে নিষেধ করা আক্ষরিক অর্থে সর্বযুগ ও সকল অবস্থার জন্য প্রযােজ্য নয়।

৫. সুস্পষ্ট দলিল বাদ দিয়ে দ্ব্যর্থবােধক দলিলের অনুসরণ করাঃ

গোঁড়ামী ও চরমপন্থার আরেকটি কারণ হচ্ছে মুহকাম বা সুস্পষ্ট দলিল বাদ দিয়ে “মুতাশাবিহ বা দ্ব্যর্থবােধক দলিলের অনুসরণ করা। 🔹উপেক্ষা ও উগ্রতার বেড়াজালে ইসলামী জাগরণ, পৃ. ৮৬-৮৭

বিজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তি এরূপ করে না। যাদের অন্তরে বক্রতা বিদ্যমান তারাই এমন করে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

وهو الذي أنزل عليك الكتاب منه آيات نگات له أم الكتاب وأخر متقابهات فأما قابة منه البعاء الفثلة وابعاء تأويله الذين في قلوبهم زيع فرعون

“তিনিই তােমার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন যার কিছু আয়াত ‘মুহকাম এগুলাে কিতাবের মূল, আর অন্যগুলাে ‘মুতাশাবিহ’। যাদের অন্তরে সত্য-লঙ্ঘন করার প্রবণতা রয়েছে তারাই মুতাশাবিহ আয়াতগুলির অনুসরণ করে ফিতনা বিস্তার ও অপব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে।🔹সূরা আলে ইমরানঃ ৭

এ আয়াতের ব্যাখ্যা সম্পর্কে হাদীসে এসেছে :

عن عالية قالت تلا رسول الله صلى الله عليه وسلم- هذه الآية فقال: إذا رأيم الذين غوث ما نشانه مثه فأولئك الذين سقى الله فاخوشم »

আয়শা রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহা বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াত তিলাওয়াত করে বললেন- যখন তোমরা কোন মানুষকে দ্ব্যর্থবােধক আয়াতের অনুসরণ করতে দেখবে তখন জানবে এদের কথাই আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। সুতরাং তাদেরকে পরিত্যাগ করবে। 🔹সহীহ আল-বুখারী : ৪৫৪৭; সহীহ মুসলিম : ৬৯৪৬

চরমপন্থীরা সাধারণত মুতাশাবিহ দলিলের অনুসরণ করে চলে। তারা এসব দলিল দ্বারা নিজেদের হীন উদ্দেশ্য সফল করতে সচেষ্ট হয়। তারা বিভিন্ন বিষয়ের অর্থ ও তাৎপর্য নির্ধারণেও মুতাশাবিহ দলিলের উপরে নির্ভর করে। ফলে বিভিন্ন ব্যক্তি ও দলের মূল্যায়নে, তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে, মুমিন বা কাফির প্রমাণে মারাত্নক ভ্রান্তিতে উপনীত হয়। 🔹ড. ইউসুফ আল-কারজাভী, ইসলামী পুনর্জাগরণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা, রূপান্তর মুহাম্মদ আখুঞ্জী (ঢাকা: আহসান পাবলিকেশন, ২০০৫,পৃ. ৫৭-৫৮) উপেক্ষা ও উগ্রতার বেড়াজালে ইসলামী জাগরণ, পৃ. ৮৭

সুতরাং কুরআন-হাদীস ভালভাবে অনুধাবন না করলে বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

৬. চরমপন্থার বেড়াজালে ইসলাম প্রচারে প্রতিবন্ধকতাঃ

ইসলাম প্রচারে স্বাধীনতা না থাকা বা ইসলামী দাওয়াতদানে প্রতিবন্ধকতা চরমপন্থা উৎপত্তির আরেকটি কারণ। 🔹 ড. ইউসুফ আল-কারযাভী, ইসলামী পুনর্জাগরণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা, রূপান্তর মুহাম্মদ সানাউল্লাহ আখুঞ্জী, ঢাকা: আহসান পাবলিকেশন,২০০৫,পৃ. ৭৯

ইসলাম শুধু ব্যক্তির জন্য নয় বরং সমষ্টির জন্য। একক ব্যক্তির বদলে সমাজের সকলকে বাঁচার প্রতি আহ্বান করে। পরস্পরের সহযােগিতা ও সৎ কাজের আদেশ শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় কর্তব্য নয় বরং একটি অপরিহার্য শর্ত। দাওয়াতী ক্ষেত্রে সামষ্টিক কাজ বাধ্যতামূলক। কাজেই ইসলাম বিরােধী শক্তি যখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলামী তৎপরতাকে নস্যাতের পাঁয়তারা করে, ইসলাম প্রচারের শান্তিপূর্ণ কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত করে তখন ধর্মপ্রাণ মুসলিম শক্তিও সহিংসতাকে সহিংসতা দিয়েই মােকাবিলা করার দিকে পা বাড়াতে পারে। উক্ত কারণে মুসলমানদেরকে সুষ্ঠু ও স্বাধীন পরিবেশে কাজ করার সুযােগ দিতে হবে। অন্যথায় এ প্রতিবন্ধকতা গােপন সহিংসতা বা চরমপন্থার জন্ম দিতে পারে।

মুসলিম দেশগুলােতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, মার্কসবাদ, লিবারেলিজম ইত্যাদি মতবাদের প্রবক্তারা যখন স্বাধীনভাবে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযােগ পায় এবং মুসলিম জনতা ইসলামের দাওয়াত দিতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন চরমপন্থা জন্ম নেয়। ১

৭. যথার্থ ধর্মীয় পরিবেশের অনুপস্থিতিঃ

সমাজে বা দেশে ধর্মীয় পরিবেশ না থাকলে ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে চরম আঘাত লাগে। ফলে তারা সমাজে ও রাষ্ট্রে ধর্মীয় পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। যার ফলশ্রুতিতে চরমপন্থা ও গোঁড়ামীর পথে কেউ কেউ যাওয়ার চিন্তা করতে পারে।

সুতরাং মুসলিম দেশে যখন ইসলামী পরিবেশের পরিবর্তে অনৈসলামী পরিবেশ গড়ে ওঠে, ইসলামের পৃষ্ঠপােষকতার বদলে ফ্যাসিবাদ, মার্কসবাদ, সেকুলারিজম, সােসালিজম ইত্যাদি লালন করা হয় তখন সেখানে গােঁড়ামী সৃষ্টি হয়। তাছাড়া মুসলিম দেশের শাসকগণ যখন কুরআন-সুন্নাহর বিধানের বদলে মানবরচিত বিধানকে অগ্রাধিকার দেয়, ন্যায়নীতির পরিবর্তে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়, ধর্মীয় শাসনের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ শাসনকে প্রাধান্য দেয় তখন গৌঁড়ামীর উত্থান ঘটে। কারণ ইসলামের বিরুদ্ধে সারাবিশ্ব ঐক্যবদ্ধ কিন্তু মুসলিম বিশ্ব ইসলামের ব্যাপারে উদাসীন। এমন বিভিন্ন দেশে মুসলমানরা নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত হলেও মুসলিম শাসকগণ মুখে কুলুপ এটে নিশ্চুপ বসে থাকেন যা গোঁড়ামী ও চরমপন্থাকে উস্কে দেয়। ২

৮. মুসলিম উম্মার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য আক্রমণ এবং গােপন ষড়যন্ত্রঃ

প্রাচ্যের ও প্রাতিচ্যের, দক্ষিণের ও উত্তরের মুসলিম বিশ্বগুলাে এবং তাদের পবিত্র স্থানগুলাে ন্যাক্কারজনক হামলা ও আক্রমণের শিকার হচ্ছে এবং মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে কখনাে প্রকাশ্য আবার কখনাে গােপন যে সব যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তার ফলেও চরমপন্থার উদ্ভব ঘটতে পারে।

🔹 আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী, উপেক্ষা ও উগ্রতার বেড়াজালে ইসলাম, অনুবাদক ড. মাহফুজুর রহমান, খায়রুন প্রাকাশনী, ২০০৪, পৃ. ১২৭-১৩০

🔹 ড. ইউসুফ আল-কারজাভী, ইসলামী পুনর্জাগরণ: সমস্যা ও সম্ভাবনা, রূপান্তর মুহাম্মদ সানাউল্লাহ আখুঞ্জী (ঢাকা: আহসান পাবলিকেশন, ২০০৫, পৃ. ৭২-৭৩; উপেক্ষা ও উগ্রতার বেড়াজালে ইসলামী জাগরণ, পৃ. ১১৬-১১৯

৯. প্রবৃত্তির অনুসরণ

গোঁড়ামী ও চরমপন্থার আরেকটি কারণ হচ্ছে প্রবৃত্তির অনুসরণ করা। 🔹ফাতহী ইয়াকান, ইসলামী সমাজ বিপ্লবে যুবসমাজের ভূমিকা, অনুবাদ ড.মাহফুজুর রহমান ঢাকা: খায়রুন প্রকাশনী, ২০০৪/১৪২৫ হি:, পৃ. ৩৩

আর মানুষ শয়তানের কুমন্ত্রণায় পড়ে কুরআন-হাদীস ছেড়ে প্রবৃত্তির অনুসরণে লিপ্ত হয়। শাইখ আব্দুল মুহসিন বলেন :

فان للشيطان مدخلين على المسلمين ، ينفذ منهما إلى أغوائهم وأصلالهم، أحدهما أنه إذا كان المسلم من أهل التفريط والمعاصی ، زين له المعاصي والشهوات ليبقى بعيدا عن طاعة الله ورسوله. والثاني : أنه إذا كان المسلم من أهل الطاعة والعيادة ، زين لها الإفراط والغلو في الدين ، ليفسد عليه دينه

মুসলমানদের বিপথগামী ও পথভ্রষ্ট করার ক্ষেত্রে শয়তানের দুটি পদ্ধতি রয়েছে, যা মানুষকে বিপথগামী ও পথভ্রষ্ট করতে সে প্রয়ােগ করে। প্রথমত: যদি মুসলিম ব্যক্তি চরমপন্থী ও অবাধ্য হয় তাহলে তার নিকট অবাধ্যতা ও প্রবৃত্তিকে শয়তান সুশােভিত করে উপস্থাপন করে যাতে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ থেকে দূরে থাকে। দ্বিতীয়ত: যদি মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত ও ইবাদতগুজার হয় তাহলে শয়তান গোঁড়ামী ও চরমপন্থাকে তার সামনে সুন্দর করে উপস্থাপন করে যাতে তার দ্বীন পালনে সে বিভ্রান্ত হয়”🔹আব্দুল মুহসিন ইবনু হামদ আল-আব্বাদ আল-বদর, বিআইয়ে আকলিন ওয়াদ্বীনিন ইয়াকুনুত তাফজীর ওয়াত তাদমীর জিহাদান (রিয়াদ: দারুল মুগনী লিন নাস ওয়াত তাওযি ১ম প্রকাশ, ২০০৩/১৪২৪ হি:, পৃ. ৪

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাদীসেও এর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

“জান্নাতকে অপছন্দনীয় জিনিস দ্বারা এবং জাহান্নামকে প্রবৃত্তি দ্বারা আবৃত করে রাখা হয়েছে”। 🔹সহীহ মুসলিম : ৭৩০৮

শাইখ আব্দুল মুহসিন আল-আব্বাদ আরাে বলেন :

ومن مكائد الشيطان لهؤلاء المفرطين الغالين أنه يزين لهم أتباع الهوى وركوب رؤوسهم الفهم في الدين ويزهدهم في الرجوع إلى أهل العلم لئلا يبروهم ويرشدهم إلى الصواب وليبقوا في غيهم وضلالهم –

শয়তানের ধোঁকা ও প্রতারণাই চুড়ান্ত গোঁড়া ও চরমপন্থিদের সামনে প্রবৃত্তির অনুসরণ, ঔদ্ধত্যের শীর্ষে আরােহণ ও দ্বীন সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পােষণ করা সুসজ্জিত করে উপস্থাপন করে এবং বিজ্ঞ আলিমদের থেকে বিমুখ করে রাখে, যাতে বিদ্বানরা তাদের সঠিক জ্ঞান ও সুসজ্জিত করে উপস্থাপন করে এবং বিজ্ঞ আলিমদের থেকে বিমুখ করে রাখে, যাতে বিদ্বানরা তাদের সঠিক জ্ঞান ও সুপথ প্রদর্শন করতে না পারে। আর তারা (চরমপন্থীরা) যেন তাদের সীমালঙ্ন ও ভ্রষ্টতার মধ্যেই ডুবে থাকে। 🔹আব্দুল মুহসিন ইবনু হামদ আল-আব্বাদ আল-বদর, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪-৫

সুতরাং চরমপন্থা সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রবৃত্তির অনুসরণ যে একটি অন্যতম কারণ তা বলাই বাহুল্য।

মহান আল্লাহ প্রবৃত্তির অনুসারীকে বিভ্রান্ত বলে ঘােষণা করে বলেছেন

ومن أضل ممن اتبع هواه يعير هدى من الله به

“আল্লাহর পথনির্দেশকে অগ্রাহ্য করে যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তার চেয়ে বিভ্রান্ত আর কে হতে পারে?” 🔹 সূরা আল-কাসাস ৫০

তিনি আরাে বলেছেন :

ولا تتبع الهوى فيضلك عن سبيل الله

“আপনি প্রবৃত্তি অনুসরণ করবেন না। কারণ তা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দিবে”। 🔹সূরা সােয়াদ : ২৬

আল্লাহ তা’আলা আরাে বলেছেন

ولا تتبعوا أهواء قوم قد ضلوا من قبل وأضلوا كثيرا وضلوا عن سواء السبيل
“যে সম্প্রদায় ইতিপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে, অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে এবং যারা সরল পথ থেকেও বিচ্যুত হয়েছে, তােমরা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করাে না”। 🔹 সূরা আল-মায়িদা : ৭৭

১০. শরীয়তের উপর ব্যক্তিপূজার প্রাধান্য

ব্যক্তিপূজার মাধ্যমেও গোঁড়ামীর বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। অথ্যাৎ ব্যক্তির আনুগত্যে সীমালঙ্নের মধ্য দিয়ে গোঁড়ামীর উদ্ভব ঘটে। একারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

لا تطروني كما أطرت النصارى ابن مريم فإنما أنا عيده فقولوا عبيد الله ورسوله

“তােমরা আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করাে না খ্রিষ্টানরা যেমন ঈসা আলাইহিস সালাম এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছিল। আমি কেবল আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তােমরা বল আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল”। 🔹 সহীহ আল-বুখারী: ৩৪৪৫

সমাজের একশ্রেণীর মানুষ নীতি ও আদর্শের চেয়ে ব্যক্তিপূজায় বেশি ব্যস্ত। আদর্শের চেয়ে ব্যক্তির সাথে তাদের সম্পর্ক হয় গভীর। এর ফলে মুসলিম সমাজে ফিতনা- ফাসাদ সৃষ্টি হয়। এর মূল কারণ হচ্ছে তাকওয়া ও শরীয়তের চেয়ে ব্যক্তির প্রতি তাদের আসক্তি অত্যধিক। এর ফলে সমাজে বিভেদ, দলাদলি ও মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিপ্রেম ও প্রবৃত্তিপূজা আদর্শ ও মূল্যবােধের স্থান দখল করে। ফলশ্রুতিতে গোঁড়ামী ও চরমপন্থার সৃষ্টি হয়। 🔹 ইসলামী সমাজ বিপ্লবে যুবসমাজের ভূমিকা, পৃ. ৩১-৩২

উপরােক্ত কারণগুলাে গোঁড়ামী ও চরমপন্থা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে কারণ হতে পারে; তবে কোন কোন কারণ চরমপন্থীদের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে বিবেচিত নাও হতে পারে। যারা চরমপন্থা ও উগ্রবাদকে দমন করতে চান তাদের এ বিষয়গুলাের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার জন্য সচেতনভাবে মনে রাখতে হবে।
━━━━━━━━━━━━━━━━
(অত্র লেখাটি মােঃ মুখলেছুর রহমান প্রণীত “গোড়ামী ও চরমপন্থা: ইসলামী দৃষ্টিকোণ” বই থেকে সংগৃহীত)

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর..
জনপ্রিয় পোস্ট
সর্বশেষ আপডেট