মাওলানা মামুনুল হক সাহেবের হেফাজত থেকে পদত্যাগ করা উচিত।
পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম কাজগুলোর একটি হলো নেতৃত্ব দেয়া। ইসলামী সংগঠনের নেতৃত্ব দেয়া আরো কঠিন কাজ। আল্লাহর রহমত, পরামর্শ, বিনয়, সততা, তাকওয়া, দূরদর্শিতা ইত্যাদির ওপর ভর করে ইসলামী নেতৃত্ব সফলতা পায়।
এর কোনো একটাতে সমস্যা তৈরি হলে ইসলামী নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ একটি ধর্মীয় সংগঠন। যার ভিত্তি মূলত নৈতিকতা ও আদর্শ। এই নৈতিকতা ও আদর্শের কারণেই হেফাজতে ইসলামের ডাকে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। অকাতরে জীবন দেয়। শরীরে প্রচণ্ড আঘাত নিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসে। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে বসে তৃপ্তিবোধ করে।
ফলে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতৃত্বকে তাকওয়া, সততা ও আদর্শের মানে সর্বোচ্চমান নিশ্চিত করা জরুরী। কোনো কারণে এই জায়গায় ছাড় দেয়ার সুযোগ নাই।
সম্প্রতি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের এক যুগ্ম মহাসচিব ও কার্যত সংগঠনের মুখপাত্র হয়ে ওঠা একজন নেতার ব্যক্তিগত কিছু বিষয় সামনে এসেছে।
বিষয়টির দুইটা দিক আছে। একটা দিক হলো, নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ, প্রাইভেট প্রাইভেসি লঙ্ঘন, কিছু মিডিয়ার দ্বিচারিতা এবং মাওলানা মামুনুল হকের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ।
একই সাথে এর আরেকটি দিকও আছে। সেই দিকটা হলো, মাওলানা মামুনুল হকের প্রশ্নবিদ্ধ তাকওয়া, অদূরদর্শীতা, সময়জ্ঞান ও আদর্শের উচ্চমান রক্ষায় ব্যর্থতা।
এখানে কয়েকটি জিনিস বিবেচ্য।
১. দ্বিতীয় বিয়ে প্রয়োজনের খাতিরে শরীয়াহ সম্মত। কিন্তু, তাঁর এই মানবিক বিয়ের পেছনের যে গল্প তাতে আপত্তি করার মতো যথেষ্ট রসদ রয়েছে। বন্ধুর পারিবারিক সমস্যা, সেই বন্ধু ও তার পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠতা এবং বিচ্ছেদে পরিণত হওয়ার ছয় মাসের মাথায় সেই মেয়েকে বিয়ে করার এই মানবিক গল্পের পেছনে পরকীয়ার ছায়া দেখতে পাওয়া অতি স্বাভাবিক। সেই ছায়া আমলে না নিলেও এখানে তিনি সতর্কতার উচ্চমান রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন এটা সত্য।
২. সন্মানিতা সেই নারী তালাকের পরে তাঁর সাথে মামুনুল হক সাহেবের যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়া এবং তাকে সহায়তা করার যে মানবিক গল্প তিনি লিখেছেন সেটা সমর্থনযোগ্য নয়। যদি সেই নারীকে সহায়তা করতেই হতো তাহলে মামুনুল হক সাহেব তার স্ত্রীর মাধ্যমে করাতে পারতেন। তা না করে নিজেই কথাবার্তা চালানো তার মতো মানুষের জন্য শোভনীয় নয়।
৩. একজন বিধবা নারীকে কেবলই সহায়তার জন্য বিয়ে করার বর্ণনায় অন্য কোনো কিছুর প্ররোচনা এড়ানো দুস্কর।
৪. বিয়েতে ই’লান বিন নিকাহ কোনো কোনো মাজহাবমতে ওয়াজিব। আমাদের মাজহাবমতে ওয়াজিব না হলেও ই’লান বিন নিকাহকে গুরুত্বপূর্ণ সাব্যস্ত করা আছে। তাঁর বিয়ে শরীয়াহ সম্মত হলেও তার মতো একজন নেতার এমন গোপন বিয়ে নিঃসন্দেহে বোকামীসূলভ আচরণ।
৫. দ্বিতীয় বিয়ে প্রয়োজনে জায়েজ। এখানে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি শরীয়াতে জরুরী না হলেও দুই বছরের অধিককাল প্রথম স্ত্রীর কাছ থেকে দ্বিতীয় বিয়ের বিষয়টি গোপন করা প্রথমজনের সাথে এক ধরনের প্রতারণা।
৬. তার নেতৃত্বে ঘটে যাওয়া আন্দোলনে ২০ জন শহীদ হলো, ৫ হাজারের ওপরে মানুষ আহত হলো, শতাধিক মানুষ গ্রেফতার হয়ে অন্ধ প্রকোষ্ঠে হাহাকার করছে। এমন মুহুর্তে দামী রিসোর্টে অবকাশ যাপন যতটা না জায়েজ নাজায়েজের প্রশ্ন তার চেয়ে বেশি দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ, কর্মীদের প্রতি মমত্ববোধের প্রশ্ন। তিনি এখানে কর্মীদের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীনতা প্রদর্শন করেছেন।
৭. রিসোর্টের রেজিস্ট্রারে প্রথম স্ত্রীর নাম, ঠিকানা লেখা একটি পরিস্কার মিথ্যা ও প্রতারণা। যা তার সাথে কোনোভাবেই যায় না।
৮. তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে বিয়ের বিষয়টি শরীয়াহ সম্মত হলেও রাষ্ট্রের আইনে এটা বিয়ে বলে গণ্য নয়। এখন প্রশ্ন হলো, শরীয়াহ সম্মত বিয়ে হওয়ার পর সেই বিয়েকে রেজিষ্ট্রেশন করতে তার আপত্তি কোথায়? তিনি কি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর আইনগত অধিকার এড়াতে চাইছিলেন? জনাব মামুন সাহেবের মৃত্য হলে এই স্ত্রী তো সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। একজন নারীকে এই ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রাখার কী যুক্তি থাকতে পারে? যাকে তিনি মানবিক কারণে বিয়ে করেছেন?
৯. এই ধরনের আইনী স্বীকৃতি বিহীন একজন নারীর সাথে যোগাযোগ, সম্পর্ক ও স্ত্রীসুলভ আচরণ তো তাকে যেকোনো সময়ে বিপদের মুখে ফেলতে পারতো।
১০. এই স্ত্রীর সন্তান হলে সেই সন্তানকেও তো এভাবে কুল্লামার কসম করে পিতৃপরিচয় সাব্যস্ত করতে হতো!
সার্বিক বিবেচনায় মাওলানা মামুনুল হক নৈতিক দুর্বলতা, চারিত্রিক স্খলন, অদূরদর্শীতা এবং কর্মীদের প্রতি উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন এটা দিবালোকের ন্যায় সত্য।
এমতাবস্থায় মাওলানা মামুনুল হকের উচিৎ হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করা। নিজের দুর্বলতার ভার সংগঠনের ওপর না চাপানো। তার এই দুঃসময়ে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ও সাধারণ জনতা তার পক্ষে যেভাবে লড়াই করেছে তাতে তার কৃতজ্ঞ ও লজ্জিত হওয়া উচিৎ। তার ভাবা উচিৎ যে, মানুষ যে ভালোবাসা দেখিয়েছে তিনি তার মর্যাদা রক্ষা করতে পেরেছেন কিনা? তার নিজের আত্মসমালোচনা করে নিজেই হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে সংগঠনকে কলংকমুক্ত করা উচিৎ।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতৃত্বকেও বিষয়টি আবেগ-অনুভূতি, শ্রদ্ধাবোধ, ব্যক্তি অনুরাগের উর্ধে উঠে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
জনাব মামুনুল হকের পক্ষে দল হিসেবে হেফজত ও তার কর্মীরা যা করেছে তা যথেষ্ট। তাকে তার বিরুদ্ধ শক্তির ছোবল থেকে উদ্ধার করা, মিডিয়ার হামলা থেকে রক্ষা করা, তার পক্ষে বয়ান তৈরি করা, অনলাইলে যুদ্ধ করা সবই ঠিকাছে। তিনি জুলুমের শিকার হয়েছিলেন। তাকে রক্ষা করা হয়েছে।
কিন্তু, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়। দলের চেয়ে আদর্শ বড়। তার কার্যক্রম অনেক যৌক্তিক প্রশ্নের সম্মুখীন, তিনি নৈতিকতা, সততা, আদর্শ, তাকওয়া, দায়িত্ববোধ, দূরদর্শিতার কাঙ্খিত মান রক্ষায় বাজেভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি নৈতিকতা ও আদর্শের ওপরে দাঁড়ানো হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দিয়েছেন। তার কর্মকাণ্ডে ইসলাম ও ইসলামী নেতৃত্বকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছেন।
এহেন পরিস্থিতিতে হজরত উমর রা. -এর কর্মপন্থা অনুসরণীয়। তিনি তার নিয়োগকৃত কোনো গভর্নরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠা মাত্র তার দায়িত্ব স্থগিত করতেন। তদন্ত করে নির্দোষ প্রমাণিত হলে পূনরায় দায়িত্বে বহাল করতেন। অন্যথায় বাদ দিতেন। তার এই নীতিতে জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত মহান সাহাবীরও দায়িত্ব স্থগিত করা হয়েছিল।
হজরত ওমর রা. -এর অনুসরণে মাওলানা মামুনুল হককে আপাতত দলের সকল দায়-দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া উচিৎ। এতে করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নৈতিক ও আদর্শিক মজবুতি রক্ষা হবে। হেফাজতের ভিত্তি আরো মজবুত হবে।
আর যদি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এক্ষেত্রে আদর্শের চেয়ে ব্যক্তি প্রভাব ও ব্যক্তি অনুরাগকে প্রধান্য দেয় তাহলে এটা হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামী সংগঠন এবং ইসলামপন্থার জন্য একটি কলংকজনক অধ্যায় সূচিত হবে। যার রেশ এদেশের ইসলামপন্থাকে বহুদিন বইতে হবে।
আশা করি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নেতৃত্ব ব্যক্তি প্রভাব ও ব্যক্তির প্রতি অনুরাগের ওপরে আদর্শ ও ইসলামের স্বার্থকে প্রধান্য দেবে।
লিখেছেন….
শরিফুল ইসলাম রিয়াদ
কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি
ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন।
Leave a Reply