ইসলামী সংস্কৃতি ও আধুনিক সংস্কৃতি
-এইচ এম মাহবুবুর রহমান
মানুষের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতি মানুষের জীবনকে করে তোলে সুন্দর, সুচারু, পরিশীলিত ও পরিমার্জিত। আর এই সংস্কৃতি যদি হয় সুস্থ ও সবল ধারার, তবে তার জীবনটা হবে সফল। সুস্থ ধারার সংস্কৃতির উৎস হলো ইসলাম। আর এর মূলে রয়েছে কুরআন ও সুন্নাহ। ইসলামী সংস্কৃতি ছাড়া অন্য কোন সংস্কৃতি সুস্থ ধারার সংস্কৃতি নয়। ইসলামী সংস্কৃতি হচ্ছে একটি মানবতাবাদী সংস্কৃতি। অন্যদিকে আধুনিক সংস্কৃতির মূলে রয়েছে ধর্মহীনতা, বেহায়াপনা ও উলঙ্গপনা, এতে নেই কোন মানবিকতা, নৈতিকতা ও শালীনতা।
সংস্কৃতির পরিচয়
“সংস্কৃতি” শব্দটি মূলত সংস্কৃত ভাষার শব্দ। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো “কালচার ” যার অর্থ কর্ষণ করা। আর আরবী প্রতিশব্দ হলো “আস সাকাফাহ।” সাকাফাহ শব্দের অর্থ উপলব্ধি করা, জানা ও প্রশিক্ষণ পাওয়া। পরিশীলিত, প্রশিক্ষিত, মার্জিত ও রুচিশীল ব্যক্তিকে বলা হয় ‘‘মুসাক্কাফ’’ বা সংস্কৃতিবান। আর সংস্কৃতি শব্দটি গঠিত হয়েছে “সংস্কার” শব্দ থেকে । যার অর্থ শুদ্ধি, পরিমার্জন, মেরামত, ভূল সংশোধন। সুতরাং সংস্কৃতি অর্থ হলো সংস্করণ, বিশুদ্ধকরণ, অনুশীলনলব্ধ দেহ, মন ও আত্মার উৎকর্ষ সাধন।
পরিভাষায় : বিশ্বাসলব্ধ মূল্যবোধে উদ্ভাসিত, পরিশীলিত ও পরিমার্জিত মন-মানসিকতাকেই সংস্কৃতি বলা হয়।
সমাজ বিজ্ঞানীদের ভাষায় সংস্কৃতি হলো : জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নিয়ম-নীতি, সংস্কার ও অন্যান্য দক্ষতা যা মানুষ সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জন করে। অর্থাৎ সংস্কৃতি হলো মানুষের আচরণের সমষ্টি।
ইসলামী সংস্কৃতি
ইসলামী সংস্কৃতি হলো ইসলামের মূলনীতির উপর ভিত্তি করে মানুষ তার আচার-ব্যবহার, দেহ, মন ও আত্মাকে যেভাবে সংস্কার ও সংশোধন করে, তাই ইসলামী সংস্কৃতি।
ড. সালেহ হিন্দি ইসলামী সংস্কৃতির সংজ্ঞায় বলেন, এ হলো এমন এক জীবন পদ্ধতি যা মুসলমানগণ প্রতিনিয়ত প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী দৃষ্টি ভঙ্গি ও জীবনাদর্শের আলোকে অবলম্বন করছে । চাই তা সামাজিক জীবনের বৈষয়িক ক্ষেত্রেই হোক কিংবা সভ্যতা নামে পরিচিত আত্মিক চিন্তার ক্ষেত্রে হোক।
ইসলামী সংস্কৃতির ভিত্তি
ইসলামী সংস্কৃতির ভিত্তি হলো কুরআন ও সুন্নাহ। সুতরাং কুরআন-সুন্নাহ বহির্ভূত কোন সংস্কৃতিকে ইসলামী সংস্কৃতি বলা যাবে না। ইসলামী সংস্কৃতি কোন ভাবেই কুরআন-সুন্নাহ বহির্ভূত সংস্কৃতি গ্রহণ করেনা। ইসলামী সংস্কৃতি কুরআন-সুন্নাহ বর্ণিত উৎসব ব্যতিত অন্য কোন উৎসব গ্রহণ করেনা। যেমন মুসলমানদের উৎসব মাত্র দু’টি ১। ঈদুল ফিতর ও ২। ঈদুল আজহা।
ইসলামী সংস্কৃতি কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী এক থাকে, কোন পরিবর্তন পরিবর্ধন হয়না।
ইসলামী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য
ইসলামী সংস্কৃতি মহান আল্লাহর তাওহীদ ভিত্তিক সংস্কৃতি অর্থাৎ যে সংস্কৃতিতে আল্লাহর সাথে র্শিকের কোন ছোঁয়া থাকবেনা।
ইসলামী সংস্কৃতির মূলনীতি ও মূল্যবোধ বিশুদ্ধ, যথার্থ, মহান ও সার্বজনীন। অর্থাৎ এটি এমন এক সংস্কৃতি যার মূলনীতি এতই বিশুদ্ধ যাতে সন্দেহ সংশয়ের কোন অবকাশ নেই। আর এটি এমন একটি সার্বজনীন সংস্কৃতি যা কোন দেশ, জাতি, ভাষা, বর্ণে সীমাবদ্ধ নয়।
এই সংস্কৃতি সকল প্রকার ত্রুটি থেকে মুক্ত এবং বিবেক ও জ্ঞানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
ইসলামী সংস্কৃতি একটি মানবতাবাদী সংস্কৃতি। এতে রয়েছে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা।
মহান আল্লাহর বাণী, اِنَّ اَکۡرَمَکُمۡ عِنۡدَ اللّٰهِ اَتۡقٰکُمۡ “নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন।” (সূরা হুজরাত : ১৩)
ইসলাম মানুষকে সর্বোত্তম আদব বা শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার জন্য এসেছে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,بُعِثْتُ لأُتَمِّمَ مَكَارِمَ الأَخْلاقِ ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের জন্য প্রেরিত হয়েছি’। (শরহুস সুন্নাহ, মিশকাত হা/৫০৯৬; ছহীহাহ হা/৪৫; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/২৭৩)
আয়েশা (রাঃ)-কে রাসূল (ছাঃ)-এর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি উত্তরে বলেন, كَانَ خُلُقُهُ الْقُرْآنَ‘তার চরিত্র হ’ল কুরআন’। (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৩০৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৮১১)
ইসলামী সংস্কৃতি একজন মুসলমানকে আনুগত্যশীল করে তোলে। সে আরো বেশি রাসূল (সা.) এর সহীহ সুন্নাহ অনুযায়ী তার জীবন পরিচালনা করতে তৎপর হয়।
এটি এমন এক সংস্কৃতি যাতে রয়েছে মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ। হাদীসে বর্ণিত আছে,
হজরত সাহল ইবনে সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী স্থানের (জিহবার) এবং দুই রানের মধ্যবর্তী স্থানের (লজ্জাস্থানের) জিম্মাদার হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হবো। (সহীহ বুখারী : ২১০৯)
ইসলামী সংস্কৃতি নৈতিকতা সমৃদ্ধ এবং মানুষের ধর্ম কর্মের সমন্বয়ক।
আধুনিক সংস্কৃতি
আধুনিক সংস্কৃতি বলতে মূলত পশ্চিমা সংস্কৃতিকেই বুঝায়। যাতে কোন ধর্মের ছোঁয়া নেই, নেই কোন নৈতিকতা, মানবিকতা ও শালীনতা। এতে আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর নির্দেশ পালন করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এটি একটি উলঙ্গপনা (Free sex) সংস্কৃতি।
আধুনিক সংস্কৃতির ভিত্তি
আধুনিক সংস্কৃতির ভিত্তি হলো ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ খৃষ্টবাদ, ইহুদিবাদ, পুঁজিবাদ ও অন্যান্য পার্থিব মতবাদ। যার মূল উদ্দেশ্য হলো ধর্মহীনতা। এই সংস্কৃতির মূল কথা হচ্ছে পাশ্চাত্য সভ্যতাকে নির্বিচারে গ্রহণ করা এবং যারা এর বিপরীতে দাঁড়ায় তাদেরকে অসভ্য ও পশ্চাতপদ গণ্য করা।
আধুনিক সংস্কৃতির কতগুলো দিক
১. বাঙালি সংস্কৃতি।
২. হিন্দি সংস্কৃতি।
৩. প্রাচ্য সংস্কৃতি।
৪. পাশ্চাত্য সংস্কৃতি।
আধুনিক সংস্কৃতির ক্ষুদ্র রূপায়ন
ক. স্যাটেলাইট সংস্কৃতি।
খ. সিনেমা বা চলচিত্র সংস্কৃতি।
গ. অশ্লীল পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিন সংস্কৃতি।
ঘ. সুন্দরী প্রতিযোগিতা ও মডেলিং সংস্কৃতি।
ঙ. পার্লার সংস্কৃতি।
চ. দিবস পালন/উৎসব সংস্কৃতি।
ছ. অগিড়ব সংস্কৃতি।
জ. গায়ে হলুদ সংস্কৃতি।
ঝ. পহেলা বৈশাখ সংস্কৃতি।
ঞ. বউ ভাত।
আধুনিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য
১. আধুনিক সংস্কৃতি মূলত একটি ধর্মহীন সংস্কৃতি । যা মানুষের ধর্মীয় চেতনাকে নষ্ট করে দেয়। ফলশ্রুতিতে সে তার ধর্ম থেকে দূরে সরে যায় এবং এটি মুসলমানদেরকে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসূল (সা.) এর অনুসরণ থেকে বিমুখ করে।
২. আধুনিক সংস্কৃতির মধ্যে জীবনের দৃশ্যমান ও আনুভূতিক শিল্পময় প্রকাশ লক্ষ করা যায়। আর এতে লাগামহীন জীবন যাপনের উলঙ্গতাকে নানাভাবে বর্ণময় করার চেষ্টা দেখা যায়।
৩. আধুনিক সংস্কৃতি বিভিন্ন উৎসব সাদরে গ্রহণ করে নেয়, ইসলামে যার কোন ভিত্তি নেই। যেমন- শবে বরাত, থার্টি ফাস্ট নাইট, ভ্যালেন্টাইন ডে, এপ্রিল ফুল, বিবাহ বার্ষিকী, জন্ম দিন, গায়ে হলুদ উৎসব, মহররম উৎসব ইত্যাদি।
৪. আধুনিক সংস্কৃতি বংশানুক্রমে অতিবাহিত হতে থাকে। যদিও এর মধ্যে কুফরী কোন সংস্কৃতি থাকে তবুও বংশানুক্রমে তার ধারা বজায় থাকে।
৫. আধুনিক সংস্কৃতি একটি প্রতিযোগিতা মূলক সংস্কৃতি। যার কারণে এর ধারা বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তন হয় এবং এটি বিশ্বে আলোচিত অনেক কিছু সাদরে আপন করে নেয়।
৬. আধুনিক সংস্কৃতি মুসলমানদের ঈমানী চেতনাকে নষ্ট করে দেয়। যার কারণে সে আল্লাহ ও রাসূল (সা.) এর আনুগত্য থেকে দূরে সরে যায়। আর অন্য দিকে ইসলামী সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে কেবল আল্লাহ ও রাসূল (সা.)-এর উপর নিঃশংসয়ভাবে বিশ্বাসী মুমিনদের জীবন যাপনকে কেন্দ্র করে। যেখানে অবিশ্বাসী হওয়ার বা কুরআন- হাদীস অনুসৃত জীবন যাপনের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
অন্য জাতির সংস্কৃতি গ্রহণ করার ভয়াবহতা সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, «من تشبه بقوم فهو منهم» “যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাদৃশ্য ধারণ করলো সে তাদেরই দলভুক্ত হলো।” (সুনানে আবু দাউদ :৪০৩১)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত অন্য হাদীসে রাসূল (সা.) বলেন, তিন প্রকারের লোক আল্লাহর কাছে সর্বাধিক ঘৃণিত, ১. হারাম শরীফের পবিত্রতা বিনষ্টকারী, ২. ইসলামে বিজাতীয় রীতি-নীতির (সংস্কৃতির) প্রচলন কারী, ৩. কোন মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যার প্রচেষ্টাকারী। (বুখারি)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতিয়মান হয় যে, বর্তমান সময়ে আমরা যে সংস্কৃতিকে আমাদের প্রকৃত সংস্কৃতি বলে মনে করি অর্থাৎ ইসলামী সংস্কৃতি বলে মনে করি তা আসলে ইসলাম তথা কুরআন-সুন্নাহ স্বীকৃত সংস্কৃতি নয়। এর অর্থ হলো আমরা মুসলিম জাতি বিশ্বে আজ যে সংস্কৃতিতে নিজেদের আপন করে নিয়েছি , তা হয়তো খ্রিস্টিয় সংস্কৃতি অথবা ইউরোপিয় ও আমেরিকান সংস্কৃতি তথা মানুষের মনগড়া মতাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি।
আবার বিভিন্ন জনপদে এই সংস্কৃতি পালন করে পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতি বলে। অন্যদিকে কেউ কেউ এই সংস্কৃতি পালন করে আলট্রা মডার্ণ (অত্যাধুনিক) হওয়ার জন্য। রাসূল (সা.) এর জীবন পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহর রাসূল (সা.) যখন মক্কার কুরাইশদেরকে কালিমার দাওয়াত দিয়েছিল তখন তারাও বলেছিল আমরা কি আমাদের পূর্ব-পুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করে তোমার এই নতুন ধর্ম গ্রহণ করবো? অথচ আমরা অনেকদিন থেকেই এই ধর্ম পালন করে আসছি। সুতরাং পূর্ব-পুরুষদের সংস্কৃতিকে নিজেদের জন্য বৈধ সংস্কৃতি রূপে গ্রহণ করার কোন অবকাশ ইসলামে নেই।
আজ বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলমানগণ যে সংস্কৃতি লালন করছে তা ইসলাম স্বীকৃত সংস্কৃতি নয়। এ দেশের সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছে ইউরোপিয়ান সংস্কৃতি, ভারতীয় সংস্কৃতি ও আমরিকান সংস্কৃতি, যেগুলো হলো অসুস্থ ধারার সংস্কৃতি।
ইসলামী সংস্কৃতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য প্রস্তুত করা। আর এই সফলতা আসবে বর্তমান জীবনে মানুষের নির্ভুল আচরণের মাধ্যমে। এই সংস্কৃতি এমন একটি নির্ভুল সমাজ কায়েম করতে চায়, যা হবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ। এর জন্য প্রয়োজন উত্তম চরিত্র ও সৎগুণ।
তাই আসুন আমরা মুসলিম হিসেবে আমাদের যে সংস্কৃতি গ্রহণ করা প্রয়োজন তাই আমরা লালন করবো। আর সেই সংস্কৃতি হলো ইসলামী সংস্কৃতি । তাহলে আমাদের সমাজ থেকে অন্যায়-অশ্লীলতা দূর হবে এবং সমাজে আমরা সুন্দর ও সুস্থভাবে জীবন যাপন করতে পারবো। আল্লাহ আমাদেরকে এই ধরনের সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার তাওফীক দান করুন। আমীন !
Leave a Reply